বৃত্তাকার শহর বাগদাদ ~ ইসলাম পরিচয়

বৃত্তাকার শহর বাগদাদ

 

 

 ছবিতে দেখানো গোলাকার এই শহরের সাথে অনেকেই পরিচিত। এটি বাগদাদ শহরের একটি ছবি, যে শহরটি এই রুপ নিয়ে গড়ে উঠেছিল অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে, আব্বাসীয় খলিফা আল-মানসুরের সময়ে। সেই সময় বাগদাদকে ডাকা হতো ‘শান্তির শহর’ নামে। আর এখন আমরা সেই সময়ের বাগদাদকে বলি ‘বৃত্তাকার শহর’ বা ‘দ্য রাউন্ড সিটি’ নামে। বৃত্তাকার বাগদাদের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ৭৬২ সালের ৩০ জুলাই থেকে। এই শহরটি নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলার জন্যই লেখা।

বৃত্তাকার শহর বাগদাদ
বৃত্তাকার শহর বাগদাদ
                             

আল-মানসুর যখন বাগদাদকে একটা বিশেষ কিছু হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন, তখন উদ্দেশ্য ছিল খেলাফতের প্রশাসনিক কার্যক্রমও হারান থেকে নবনির্মিত এই শহরে নিয়ে আসা হবে। সেই মোতাবেক নকশা ও নগর-পরিকল্পনা শুরু হলো। গ্রীক গণিতবিদ ইউক্লিডের জীবন ও নানা কাজ সম্পর্কে ভালই জানাশোনা ছিল খলিফার, তাকে বেশ শ্রদ্ধাও করতেন তিনি। ইউক্লিডের বিভিন্ন জ্যামিতিক শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই বৃত্তাকৃতির এই শহরটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।


বৃত্তাকার এই শহরকে পুরোপুরি ইউনিক কিংবা অভূতপূর্ব বলার সুযোগ নেই। কারণ, পারস্যের সাসানীয় সাম্রাজ্যকালীন শহুরে নকশার ছাপ আছে এই শহরে। আরও ভাল করে বললে, প্রাচীন সাসানীয় শহর ফিরুজাবাদের সাথে বেশ মিল পাওয়া যাবে বাগদাদের গঠনশৈলীর। অবশ্য এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক, কারণ নগর-পরিকল্পনার সাথে যারা জড়িত ছিলেন তাদের মাঝে দুজন ছিলেন পারস্যের অধিবাসী; একজন নবাখ্‌ত আহ্‌ভাজি, অন্যজন মাশাআল্লাহ্‌ ইবনে আছারি (নাম দেখে মুসলিম ভাবার দরকার নেই; ধর্মীয় বিশ্বাসগত দিক থেকে তিনি ছিলেন ইহুদী)।


যা-ই হোক, আজকের দিনে শহর নির্মাণ শুরুর সিদ্ধান্ত পাকা হবার পর এই দিন প্রথমেই নামাজ পড়ে আল্লাহ্‌র কাছে প্রাণভরে এই শহরটি নিয়ে দোয়া করেন আল মানসুর, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, “আমার তো এই শহরেরই গোড়াপত্তন করে যাবার কথা, এই শহরেই বসবাস করার কথা, আর এখান থেকেই আমার উত্তরসূরীরা শাসনকার্য পরিচালনা করবে।”


দোয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ইটটি বসান আল-মানসুর, এরপরই ঘোষণা দেন কাজ শুরুর। ১ কিলোমিটার ব্যাসবিশিষ্ট এই শহরের বিশাল কর্মযজ্ঞ শুধু বাগদাদই না, বরং বিশ্বের ইতিহাসেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।


আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের প্রতিটি প্রান্ত থেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সেরা সব ব্যক্তিকেই নিয়ে আসা হয় শহর নির্মাণে। হাজার হাজার স্থপতি, প্রকৌশলী, আইনজ্ঞ, জরিপ পরিচালনাকারী, ছুতার, কামার, মাটি খননকারী এবং অন্যান্য নানাবিধ কাজের জন্য সাধারণ শ্রমিক জড়ো হয় বাগদাদে। ইসলামী দুনিয়া এর আগে এত বড় নির্মাণকার্য আর দেখেনি। আহমাদ আল ইয়া’কুবির মতে, প্রায় ১,০০,০০০ লোক এই শহরটির নির্মাণের সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিল।


একের পর এক ইট দিয়ে গড়ে উঠতে থাকলো বাগদাদের দেয়ালগুলো, যা এই শহরের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিষয়। একাদশ শতকের ইতিহাসবিদ আল খতিব আল বাগদাদীর মতে, দেয়ালগুলো তিনটি স্তরে উপরে তোলা হয়েছিল। উচ্চতার প্রথম এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে ব্যবহৃত হয় ১,৬২,০০০ ইট, পরবর্তী এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে ১,৫০,০০০ এবং সর্বশেষ অংশে ১,৪০,০০০ ইট ব্যবহৃত হয়। বাইরের দেয়ালটি ছিল ৮০ ফুটের মতো উঁচু, যার চারদিক ঘিরে ছিল এক গভীর পরীখা, ছিল নগর প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নানা ব্যবস্থাও।


চারটি মূল ফটক বেরিয়ে গিয়েছিল শহরটি থেকে: ১) দক্ষিণ-পশ্চিমে বাব আল-কুফা, ২) দক্ষিণ-পূর্বে বাব আল-বসরা, ৩) উত্তর-পশ্চিমে বাব আল-শাম, এবং ৪) উত্তর-পূর্বে বাব-আল খোরাসান। শহরের কেন্দ্র থেকে চারটি মহাসড়ক চলে গিয়েছিল এই চার ফটকে, আর এই চার সড়কের আশেপাশে ছিল নানা দোকান ও বাজার। সেসব সড়ক থেকে বের হয়েছিল নানা উপসড়ক, যেগুলো আমাদের চিরচেনা নানা ছোট ছোট রাস্তা বা গলির মতো কাজ করত।


শহরটির কেন্দ্র ছিল আরেক দেখার মতো জায়গা। প্রায় সাড়ে ছ’হাজার ফুট ব্যাসার্ধের এই কেন্দ্রে ছিল খলিফার সন্তান, রাজকর্মচারী ও আস্তাবল পরিচালনাকারীদের থাকার জায়গা, রান্নাঘর এবং বিভিন্ন সরকারি অফিস। একেবারে কেন্দ্রে ছিল চোখধাঁধানো এক মসজিদ এবং ৩,৬০,০০০ বর্গ ফুট জুড়ে বিস্তৃত খলিফার নিজস্ব প্রাসাদ ‘বাব আল যাহাব’, যা সবুজ গম্বুজওয়ালা প্রাসাদ নামেও পরিচিত। এই গম্বুজটিই ছিল আল-মানসুরের প্রাসাদের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন নিদর্শন যা বহু দূর থেকেও সহজেই দেখা যেত। আর যে মসজিদটির কথা বলা হলো, সেটি গড়ে উঠেছিল ৯০,০০০ বর্গ ফুট এলাকা নিয়ে। এটাই ছিল বাগদাদের প্রথম মসজিদ।


আনুমানিক ৭৬৬ সালে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় এই ‘শান্তির শহর’ খ্যাত বাগদাদের। আহমাদ আল ইয়া’কুবির মতে, ১ কোটি ৮০ লাখের মতো গোল্ড দিনার লেগেছিল এই পুরো শহরটি নির্মাণ করতে।


কালক্রমে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অর্থনীতির দিক দিয়ে বাগদাদ হয়ে পুরো বিশ্বের কাছেই অনুকরণীয়, অনুসরণীয় এক স্থান। এমনকি একসময় এই বাগদাদই হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র। ভারত, চীন আর উত্তর আফ্রিকা থেকে আসা জাহাজে পূর্ণ থাকতো এর নৌবন্দর। খলিফা আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে জ্ঞানী-গুণীরা ছুটে আসতেন এখানে, চলতো নানা সাহিত্যের আরবিতে অনুবাদযজ্ঞ।


মাত্র একশো বছরের ব্যবধানে এই শহরই আবার ধীরে ধীরে মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখতে শুরু করে, শুরু হয়ে যায় তার ধ্বংসের বীজ অল্প অল্প করে বোনার কাজটাও। সেই গল্প নাহয় আরেকদিনের জন্য তোলা থাকুক!


লিখেছেন: মুহাইমিনুল ইসলাম অন্তিক

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.