মাদ্রাসা শিক্ষার ইতিবৃত্তান্ত
(সংকেত সূত্র :-*ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব *মুসলিম পণ্ডিত ও পর্যটকদের অবদান *হযরত মুহাম্মদ (সাঃ )এর জ্ঞানচর্চার প্রতি গুরুত্ব *ভারতবর্ষ ও বাংলায় মাদ্রাসা শিক্ষাধারা *মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা *মাদ্রাসা শিক্ষকদের নেতিবাচক মনোভাব )
যারা আজকের পৃথিবী কে আরো সুন্দর করে আগামী দিনের উপযোগী করে গড়ে তুলতে চান শিক্ষা তাদের নিকট একটি শক্তিশালী হাতিয়ার |আর শিক্ষা নামক এই হাতিয়ারই পারে মানুষের আত্মচেতনাকে জাগ্রত করে দেশ ও সমাজকে বদলে দিতে |শিক্ষাদান কেন্দ্র রূপে যুগে যুগে মঠ মিশন টোল চতুষ্পাঠী মক্তব-মাদ্রাসা ইত্যাদি গড়ে উঠতে দেখেছি| যেগুলির একটাই উদ্দেশ্য মানুষের জ্ঞানের পরিধিকে বিকশিত করা |ইসলাম আসার সঙ্গে সঙ্গে আরব ভূমিতে এমনই একটি শিক্ষা দান কেন্দ্র রূপে মাদ্রাসার আত্মপ্রকাশ| আরবি 'দারস' শব্দ থেকে 'মাদ্রাসা' শব্দটির উদ্ভব যার অর্থ 'পাঠদান' যেখানে পাঠদান করা হয় সেটাই মাদ্রাসা|
শিক্ষার সাহায্যে নৈতিক আত্মউন্নয়নের মানুষের যে যোগ্যতা রয়েছে তার প্রতি আস্থা রেখে মুসলিম জগত সর্বপ্রথম ঘোষণা করে জীবনভর শিক্ষা সাধনার কথা |ইসলাম নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে নির্দেশ দেয় অন্যকে শিক্ষা দেয়ার জন্য নিজেকে শিক্ষিত করে তোলো | ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার চারটি উচ্চ আদর্শ হল -
1.সমাজ গড়া । 2.একমাত্র এক ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস। 3.ইহ জগৎ প্রীতির সঙ্গে কঠোর আত্মসংযম পরায়ন জীবনযাত্রা প্রণালী। 4.অধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষা অর্জন করা |মুসলিম জগত বহু দেশে ব্যাপক ভাবে এক অতি উচ্চমানের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসারে ব্রতী হয়। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেয়া হয় ধর্ম-বিজ্ঞান চিকিৎসা দর্শন গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষার উপর।
মনে রাখতে হবে ইসলাম পূর্ববর্তী প্রায় এক হাজার বছর ছিল আরব জাতির অন্ধকারময় যুগ (কোরআন শরীফে একে আইয়ামে জাহেলিয়াত আখ্যা দেয়া হয়েছে)| এই যুগ সন্ধিক্ষণে হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব আরব ইতিহাসে এক তাৎপর্যময় ঘটনা| পশ্চিম এশিয়ার বন্ধুর রুক্ষ-শুস্ক ভূখণ্ড গুলিতে বসবাসকারী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনজাতি গুলি ইসলামের ছত্রছায়ায় এসে অপরিসীম শক্তির অধিকারী হয়ে উঠল| ইসলামের ভাতৃত্ববোধ সহজ-সরল ধর্মমত সুবিচার সাম্যের আদর্শ সহনশীলতার নীতি মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করে| এসব কারণে হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম )এর মৃত্যুর 100 বছরের মধ্যে ইসলাম বিশ্বধর্মে পরিণত হয় |আরব সাম্রাজ্যের সংগঠনের পর তারা চতুর্দিকের ভূমি খন্ড গুলির উপর প্রাধান্য বিস্তার এর প্রচেষ্টা চালায় |641 খ্রিস্টাব্দে পারস্য (বর্তমান ইরাক-ইরান )অধিকারের পর 642 খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন মিশর কব্জা করলো | 732 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সাহারা মরুভূমি ও তার পার্শ্ববর্তী এক বিশাল অঞ্চলের অধিকারী হলো | ভূমধ্যসাগরের ওপর পারে অবস্থিত স্পেনের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সেও পৌঁছলেন তারা |পূর্ব দিকে ভারত ভূখণ্ড হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও সংলগ্ন দ্বীপগুলিতে ও ইসলামের প্রাধান্য বিস্তৃত হল |কৃষ্ণসাগরের অপর প্রান্তে রাশিয়ার স্টেপ অঞ্চলে ও মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হল|
এই বিপুল সাম্রাজ্যের নতুন নতুন দেশ ও অধিবাসী সম্পর্কে যে বিপুল জ্ঞান ভান্ডার অর্জিত হল তা এককথায় অভাবনীয় | হযরত_মুহাম্মদ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম )এর বাণী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আরববাসীদের মনে জ্ঞান আহরণের আকাঙ্ক্ষা দেখা দেয় |গ্রীক পারসিক ভারতীয় প্রভৃতি জাতির জ্ঞানভান্ডারে সঙ্গে এদের পরিচয় ঘটে |আরব পণ্ডিতদের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে |অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে বাগদাত ছিল জ্ঞান চর্চার প্রধান কেন্দ্র| খলিফা হারুন আল রশিদ এর পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রীক দর্শন ও বিজ্ঞানের রচনাগুলির আরবি অনুবাদ শুরু হয় |তার বিদ্যুৎসহ এত বেশি ছিল যে তিনি অনুবাদকদের লেখা বই এর সমান ওজনের সোনার দিতেও কার্পন্য করতেন না |তার অমর সৃষ্টি #আরব্য_রজনী' এই সময় স্পেনের কর্ডোভা ও আল হামারা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল জ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্র |এই সময় আলেকজান্দ্রিয়ার জাদুঘরটিতে সযত্নে সংরক্ষিত হয়েছিল বহু মূল্যবান ঐতিহাসিক সামগ্রী| শুধু জ্ঞান আহরণ নয় জ্ঞান বিতরনে ও আরবরা উৎসাহ দেখিয়েছিল |পণ্যসম্ভার নিয়ে যখন তারা এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করতো তার সঙ্গে তারা দেশ-বিদেশের জ্ঞানভান্ডার বহন করে নিয়ে যেত| তার ফলে জ্ঞান জগতে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয় |ভারতের দশমিক চিহ্ন বীজগণিত ও দোলক তাদের মাধ্যমে ইউরোপে প্রসারিত হয়| অ্যারিস্টোটল ও প্লেটোর দর্শন এবং গ্রিক বিজ্ঞান ও চিকিৎসা শাস্ত্র আরবি অনুবাদ এর ফলে ইউরোপের শিক্ষা ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়ে| চীনের কাছ থেকে শিখে আরবরাই ইউরোপে কাগজ তৈরির পদ্ধতি প্রচলিত করে |তার ফলে বইপত্র ছাপানোর ক্ষেত্রে বিপ্লবের সূচনা হয়| এই সময় আরব পণ্ডিতদের মধ্যে ইবনে সিনা ইবনে খালদুন আলবেরুনি ইবন বতুতা ইমাম গাজ্জালী (রহ:) ওমর খৈয়াম মহাকবি ফেরদৌসী প্রমূখ ব্যক্তিবর্গ বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন |এই সব মনীষীদের লেখা ভ্রমণ বৃত্তান্ত গবেষণাগ্রন্থ কাব্যগ্রন্থ এক একটি তথ্যের খনি|
মধ্য যুগে খ্রিস্টীয় ইউরোপে জ্ঞানচর্চায় যখন এক অন্ধকারময় যুগ চলছিল ঠিক সেই সময় মুসলিম জগত তার মক্তব-মাদ্রাসা কে কেন্দ্র করে প্রাচীন গ্রীক দর্শন বিজ্ঞানকে সম্বল করে ইসলামের নীতি আদর্শের সমন্বয় ঘটিয়ে জ্ঞানের দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত করে রেখেছিল |ভারতবর্ষে ইসলাম আসার সঙ্গে সঙ্গে এদেশে মক্তব মাদ্রাসার আত্মপ্রকাশ |তৎকালীন সময়ে ভারতবর্ষের জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে গুরুগৃহ, টোল চতুষ্পাঠীর সঙ্গে সঙ্গে মক্তব মাদ্রাসাগুলি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল| ঔপনিবেশিক শাসনকালে ব্রিটিশরা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অন্যান্য সমস্ত ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে সার্বজনীন শিক্ষার নামে যে শিক্ষা ব্যবস্থা করেছিল তা ছিল তাদের মনোপুত ও কর্মচারী তৈরি করার ব্যবস্থা যারা রক্ত মাংসে ভারতীয় কিন্তু নীতিবোধের ইংরেজ |কিন্তু এই মাদ্রাসাগুলি এই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে না এসে পূর্ববর্তী ধারা বজায় রাখে |তবে পরবর্তীকালে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা রূপ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়|
1780 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা মাদ্রাসা কলেজ বা #আলিয়া মাদ্রাসা এর নাম একদিকে দেশের শিক্ষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যেমন জড়িয়ে আছে সেই সাথে ভারত তথা বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে |ইংরেজরা যখন এদেশের শাসন ক্ষমতা হাতে পায় তখন ভারতবর্ষের রাষ্ট্রভাষা ছিল ফারসি |ইংল্যান্ড থেকে লোক নিয়ে এসে এদেশে শাসন ক্ষমতা চালানো অসম্ভব জেনেও ওয়ারেন হেস্টিংস 1780 খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন 1836 খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সরকার কোনরকম অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না ভারতের রাষ্ট্রভাষা ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজি করল | ফলে বহু সংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়লো |আলিয়াতে ইংরেজি ভাষার চাপ বাড়ানো হলো| এদিকে 1857 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এর নেতৃত্বে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হলে ছাত্র-ছাত্রী ও ওলামা সমাজ তাতে যোগ দেয় |এই অপরাধে ইংরেজ বাহিনী নির্মমভাবে মাদ্রাসার ছাত্র সমাজ ও উলেমাদের ফাঁসিতে ঝোলায় |অনেকের দ্বীপান্তরে পাঠানো হয় |একসময় এখানে গুজরাট কাশ্মীর বোম্বাই অসম ওড়িশা বিহার সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্ররা পড়তে আসত |ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতির্বিদ্যা দর্শন গণিত পড়ানো হতো |ভারতবর্ষের চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রথম পাঠ সূচনা এখানেই হয়| 1947 খ্রিস্টাব্দে দেশভাগ জনিত কারণে সেপারেশন কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুসারে আলিয়া মাদ্রাসা ইলিয়ট হোস্টেল ও বেঙ্গল মাদ্রাসা বোর্ড এর সমস্ত আসবাবপত্র বই পান্ডুলিপি সার্টিফিকেট সবই ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়| ফলে আলিয়া মাদ্রাসার পঠন-পাঠন এর সাময়িক ভাটা পড়ে|
দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে আলিয়া মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিনিয়র মাদ্রাসা গুলির অনুমোদন দিতো | হাই মাদ্রাসা ও ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ গুলি পরিচালিত হতো ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট বোর্ড দ্বারা |1949 খ্রিস্টাব্দে 4ঠা এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গে আলিয়া মাদ্রাসা নতুন ভাবে যাত্রা শুরু করে| তৎকালীন ভারতের শিক্ষা মন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের প্রচেষ্টায় কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ও ওয়েস্ট বেঙ্গল মাদ্রাসা এডুকেশন বোর্ড গঠিত হয় |আলিয়া মাদ্রাসার প্রথম প্রিন্সিপাল নিয়োগ করা হয় সায়েদ আহমেদ আকবারাবাদীকে সেইসাথে পদাধিকার বলে তিনি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের রেজিস্টার মনোনীত হলেন |1973 খ্রিস্টাব্দে ওয়েস্ট বেঙ্গল মাদ্রাসা এডুকেশন বোর্ড পুনর্গঠন করা হয় এবং আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ভোট কে পৃথক করা হয়| আলিয়া মাদ্রাসা চলে যায় রাজ্য সরকারের উচ্চ শিক্ষা দপ্তরের এবং পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড আলিম ফাজিল কামিল ও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ব্যবস্থা সার্টিফিকেট ডিগ্রী ও ডিপ্লোমা প্রধান ইত্যাদি বিষয় গুলির ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়|
1977 খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যের সিনিয়র মাদ্রাসা শিক্ষা নীতি অচল করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে| ফলে পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষকদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয় ও তাদের চাপে 1978 খ্রিস্টাব্দে অধ্যাপক মোস্তফা বিন কাসিম এর নেতৃত্বে সিনিয়র মাদ্রাসা কমিটি গঠিত হয় |উক্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার মাদ্রাসা শিক্ষানীতিকে ইউনিভার্সাল স্ট্যান্ডার্ড অফ এডুকেশন এর স্বীকৃতি প্রদান করে |1982 খ্রিস্টাব্দে সিনিয়র মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতন হার নির্ধারিত হয়| 1994 খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা আইন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পাস হয় | বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দুই রকম শিক্ষা ধারা রয়েছে যথা -#হাই_মাদ্রাসা ও #সিনিয়র_মাদ্রাসা| হাই মাদ্রাসার সিলেবাস মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অনুরূপ সঙ্গে রয়েছে এরাবিক সাহিত্য ও ব্যাকরণ অ্যাডভান্স আরবী এবং ইসলামের ইতিহাস |হাই মাদ্রাসার সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক থাকলে তা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের নিয়ম ও সিলেবাস অনুসারে চলে |সিনিয়র মাদ্রাসার তিনটি ধাপ 1. প্রাথমিক বিভাগ -এখানে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সিলেবাস এর সঙ্গে আরবি পড়ানো হয় 2.#আলিম (মাধ্যমিক সমতুল )এখানে বাংলা ইংরেজী গণিত ও বিজ্ঞান জীবন বিজ্ঞান ইতিহাস ভূগোল ইত্যাদির পাশাপাশি আরবি ও ধর্মতত্ত্ব পড়ানো হয়|3.#ফাজিল (উচ্চমাধ্যমিক সমতুল ) এখানে বাংলা-ইংরেজী-আরবী ধর্মতত্ত্ব ইসলামের ইতিহাস পরিবেশ বিদ্যার সঙ্গে একটি ঐচ্ছিক বিষয় (যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞান দর্শন ইত্যাদি )পড়ানো হয় |সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে পাশ করে #কামিল (স্নাতক )তারপর #এমএম ( স্নাতকোত্তর সমতুল ) পড়া যায় |এছাড়া হাই মাদ্রাসা ও সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে পাশ করে যে কোন বোর্ডে ভর্তি হওয়া যায়| এই দুই ধারার মাদ্রাসার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে আরো একটি ধারার মাদ্রাসা লক্ষ্য করা যায়| তবে তা সম্পূর্ণ বেসরকারী উদ্যোগে ও দানের টাকায় চলে |এগুলিকে খারিজি মাদ্রাসা বলা হয় |এই মাদ্রাসাগুলিতে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা ইংরেজি বিজ্ঞান ইতিহাস ভূগোল পড়ানো হয় কোথাও বা কম্পিউটার শেখানো হয় |এই শ্রেণীর মাদ্রাসাগুলিতে ছাত্ররা থাকা খাওয়া ও সঙ্গে শিক্ষা সবই পায় নিখরচায় |মূলতঃ অনাথ ও হত দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি এখানে বেশি পড়াশোনা করে |
অনেকে বলে থাকেন মুসলিম সমাজের পিছিয়ে থাকার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা দায়ী |তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই মুসলিম সমাজের যে অংশটুকু মাদ্রাসায় আসে তা খুবই নগণ্য |#সাচার_কমিটির রিপোর্ট অনুসারে তা মাত্র 4% বাকি 96
% সাধারণ স্কুলে যায়| রিপোর্ট অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের পরিমাণ 27 - 30 শতাংশ অথচ সরকারি চাকরিতে তাদের অংশগ্রহণ মাত্র 2.1 শতাংশ |সুতরাং মাদ্রাসা শিক্ষা দ্বারা মুসলিম সমাজ পিছিয়ে পড়েছে এই যুক্তি সব জায়গায় গ্রহণযোগ্য নয়|
শোনা যাচ্ছে এরা যে নতুন করে 10 হাজার মাদ্রাসার অনুমোদন দেয়া হবে |এটা নিয়ে ভাববার বিষয় আছে |কারণ 10 হাজার মাদ্রাসার অনুমোদন দেয়া হবে বটে কিন্তু তাদের সরকারি সাহায্য দেয়া হবে না |এর দ্বারা মুসলিম সমাজের খুব যে উপকার হবে তা কিন্তু নয়| তবে যেসব #খারিজি_মাদ্রাসা চলছে তাদের মূল স্রোতে আসার সম্ভাবনা থাকবে |শিক্ষকদের ও পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হলে শিক্ষাও উৎকর্ষ যে খুব বেশি বৃদ্ধি পাবে তার গ্যারান্টি দেওয়া যায় না |বরং যুগের দাবি মেনে যে মাদ্রাসাগুলি আছে সেগুলির উন্নয়নে জোর দিতে হবে আর তার সাথে যদি প্রয়োজন হয় তাহলে নতুন মাদ্রাসা গড়ে তোলা হোক সরকারি অর্থ অনুকূলে | এর সাথে যোগ দিতে হবে পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু এলাকার সাধারন স্কুলগুলির উন্নয়ন ঘটানো |শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের সুযোগ বাড়াতে হবে| অবশ্য সংরক্ষণ দিয়ে এই পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় কে এখনই বিশাল কিছু পরিবর্তন করা যাবে তা কিন্তু নয় |তবে উন্নয়নের পথে কিছুটা হলেও এগিয়ে দেয়া যাবে |এর সাথে একটা কথা বলে রাখা ভাল যদি কোন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় এর উন্নয়নের জন্য স্কুল কলেজ মাদ্রাসা বা অন্য কোনো উন্নয়নমূলক কাজ কর্ম করতে চায় তবে সরকারকে সবরকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে|
মাদ্রাসার গতি আনতে মডেল মাদরাসা ও ইংলিশ মিডিয়াম মাদ্রাসা স্থাপন লাইব্রেরী গড়ে তোলা কম্পিউটার প্রধান বৃত্তিপ্রদান ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল প্রদান গার্লস হোস্টেল তৈরি করলে হবে না |এগুলির যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কিনা তার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে |অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি ঘটা করে কম্পিউটার রুম উদ্বোধন করা হলো কিন্তু সে গুলি চালানোর জন্য শিক্ষক না থাকায় অকেজো হয়ে পড়ে আছে| লাইব্রেরী জন্য বই পত্র দেয়া হয়েছে কিন্তু লাইব্রেরীয়ান না থাকায় বইপত্র পোকায় কাটছে| অনেক মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষকের পদ দীর্ঘদিন ধরে খালি আছে |এর ফলে মাদ্রাসার পঠন-পাঠন বিঘ্ন ঘটছে| তাই তার খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনে আইন করে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে |ফাজিল এরপর আলিয়া ইউনিভার্সিটি তে কামিল ও এম এম পড়ানো হয় তার ইউজিসি স্বীকৃতি আদায় করতে হবে |মাদ্রাসা শিক্ষকদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করতে হবে |বিশেষ করে থিওলোজিও আরবী ভাষা ও সাহিত্যের |এছাড়া আরো সমস্যা গুলি অনুসন্ধান করে তার সমাধানের ব্যবস্থা করতে পারলে দেশ ও জাতি গঠনে মাদ্রাসাগুলি আবার তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে|
পরিশেষে বলি মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে আমাদের মন থেকে জড়তা দূর করতে হবে |এমনও দেখেছি কেউ কেউ মাদ্রাসায় পড়ান এই পরিচয়টুকু দিতে লজ্জাবোধ করেন |এ লজ্জা কার মাদ্রাসার না নিজের? নিজের জন্মদাতা বাবা মা নিরক্ষর হলে আমরা কি তার পরিচয় গোপন করি? সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে যে মাদ্রাসাগুলি থেকে নিজের জীবন জীবিকার সংস্থান হয় তার পরিচয় দিতে আমরা কুণ্ঠিত কেন? আমরা নিজেরাই যখন মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে একাত্ম হতে পারিনি তখন অন্যান্য সম্প্রদায় একে কেন আপন করে নেবে? সমস্যা যাই থাকুক না কেন আমরা মাদ্রাসার পরিমণ্ডলকে কে একটু পরিবর্তন করতে চেষ্টা করব না? সেন্ট জেভিয়ার্স লা মার্টিনিয়ার রামকৃষ্ণ মিশন গুলি সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হলেও সেগুলি উৎকর্ষ মূলক তাই তাদের নাম শুনলে আমাদের ইতিবাচক চিন্তা জাগে |কিন্তু সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলির নাম শুনলে আমাদের চোখ কপালে ওঠে কেন? কিন্তু এটাও সত্যি যে ভারতবর্ষের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা কতগুলি শিক্ষা কেন্দ্রের নাম করা যেতে পারে যেগুলি ভারতবর্ষের প্রথম সারির শিক্ষা কেন্দ্র হিসাবে দেশ-বিদেশের জায়গা করে নিয়েছে, যেমন- জামিয়া_মিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটি, আলিগড়_মুসলিম_ইউনিভার্সিটি, রাবিয়া পাবলিক স্কুল, কর্ণাটক এবং বাংলার আল আমিন মিশন প্রভৃতি |কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় আমরা কজন এগুলির খোঁজ খবর রাখি !আমাদের মধ্যকার এই অজ্ঞতা দূর করতে হবে |এক্ষেত্রে মিডিয়াকেও ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে |মনে রাখতে হবে একটি সম্প্রদায় কে দূরে সরিয়ে রেখে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয় আর এতে দেশের ভীত ও মজবুত হয় না |আসলে মাদ্রাসা, স্কুল এই শব্দগুলি একেকটি শব্দমাত্র আসল হলো তার কোয়ালিটি| আলিয়া মাদ্রাসা ইউনিভার্সিটি হবে না আলিয়া ইউনিভার্সিটি হবে তা নিয়ে যে কাজিয়া আমরা দেখেছি তা নিতান্তই হাস্যকর| মাদ্রাসা এই নামটি যুক্ত করা ও না করা নিয়ে হাজার হাজার পড়ুয়াকে রাস্তায় নামতে দেখেছি এ নিতান্ত লজ্জার |যে মাদ্রাসাগুলি একসময় সভ্যতার আলো জ্বালিয়ে রেখেছিল সেই মাদ্রাসা শব্দের প্রতি আমাদের এত অনীহা কেন? এসব নিয়ে চিন্তা ভাবনার সময় এসেছে|তা নাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না!
(ধন্যবাদসহ এম রুহুল আমিন)
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার:-
1. পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা আজ দেশের গর্ব: তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ' পশ্চিমবঙ্গ সরকার 2000|
2.সাচার কমিটির সুপারিশ ও সমাজসেবী বুদ্ধিজীবীদের ভাবনা :- সম্পাদনা এস এম শামসুদ্দিন শিক্ষার ভূমিকা পশ্চিমবঙ্গ
3.শিক্ষার ভূমিকা -নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি
4.ইসলামী শব্দকোষ -মিলন দত্ত
5.ভূগোল চিন্তার বিকাশ -কুন্তলা লাহিড়ী দত্ত 6.বাংলার হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক -নজরুল ইসলাম
7.পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ- খাইরুল বাশার
8.মুসলিম সমাজ এবং এই সময়- প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড :সম্পাদনা মইনুল হাসান
9.ইতিহাস (মধ্যযুগ) পশ্চিমবঙ্গ মধ্য শিক্ষা পর্ষদ 10.মাদ্রাসা শিক্ষা পশ্চাতে রেখেছ যারে( শিক্ষালোক - জানুয়ারি মার্চ 2013)- এম রুহুল আমিন 11.মাদ্রাসা শিক্ষা :একটু ভেবে দেখা -এম রুহুল আমিন (সময়ের সাথি পঞ্চম বর্ষ ষষ্ঠ সংকলন 2015)
12. সমসাময়িক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা
রিপোস্ট ©এম রুহুল আমিন
কোন মন্তব্য নেই: