জ্যোতির্বিজ্ঞানে আরাবদের অবদান ~ ইসলাম পরিচয়

নাসিরউদ্দিন আততুসি

*জ্যোতির্বিদ্যা ও মুসলমান*


মুসলমানরা কয়েকটি কারণের জন্য জ্যোতির্বিদ্যা চর্চায় আগ্রহী হয়ে পড়েছিল। তন্মধ্যে প্রথমত- ধর্মীয় কারণ, দ্বিতীয়ত- সাংস্কৃতিক কারণ, তৃতীয়ত- পর্যটন কারণ।

*১) ধর্মীয় কারণ:-*

 ধর্মীয় কারণের অর্থ এই যে, মুসলমানদের প্রতিদিন নামাজের সঠিক সময়, কিবলা ও নামজের প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো অবগত হওয়ার জন্য। রমজান ও হজ্বের মাসে চাঁদ দেখার জন্য, মুসলমানরা জ্যোতির্বিদ্যায় জ্ঞানার্জন করতে আগ্রহী হয়েছিল।

*২) সাংস্কৃতিক কারণ:-* খোলাফায়ে রাশেদীন, উমাইয়া ও আব্বাসীয়দের সময়কালে মুসলমানদের সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্কের আদান-প্রদান ঘটেছিল। তখন মুসলমানরা লক্ষ্য করেছিল যে, অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অনেক প্রভাব রয়েছে। ফলস্বরূপ মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় আগ্রহী হয়েছিল।

*৩) পর্যটন কারণ:-* মুসলমানদের সরকারি কার্যাদি সম্পন্ন করার জন্য। যেমন- ডাক বিভাগের কাজ, সৈন্যবাহিনী দূরবর্তী স্থানে প্রেরণ করার জন্য,৷ মুসলমানদের হজ্বে যাওয়ার পথনির্দেশনা দিতে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ কারণেই মুসলমানরা জ্যোতির্বিদ্যা চর্চায় আগ্রহী হয়েছিল।


*★ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের অনুবাদ:-* 

আব্বাসীয় সময়কালে বাগদাদে গ্রীক ও ভারতীয় ভাষায় রচিত বিজ্ঞানের অনুবাদ আরবী ভাষায় শুরু হয়েছিল। তখন আরবী ভাষায় জ্যোতির্বিদ্যার বিষয়ের উপরে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের অনুবাদ হয়েছিল। তন্মধ্যে একটি বইয়ের নাম ‘সিদ্ধান্তা’। যার লেখক হলেন আরিয়া ভট্টা। তিনি ভারতবর্ষের একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। এই বইয়ের আরবী ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন- মুহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহীম ফাজারী। দ্বিতীয় বইয়ের নাম ‘আল-ম্যাজিস্ট’ (Al-Magest / المجسطي)। এই বইয়ের লেখক হলেন- টলেমি, আরবী ভাষায় টলেমিকে বাতলিমুস (بطليموس) বলা হয়। এই দুটো বইয়ের অনুবাদ কার্য আব্বাসী খলীফা আবু জাফর আল-মানসূরের সময়কালে হয়েছিল। এই দুটো বইকে মুসলমানরা অনেক গুরুত্ব দিয়েছিল। তাই বলা যায় যে, মুসলমানদের জ্যোতির্বিদ্যার উপরে গ্রীক ও ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার গভীর প্রভাব ছিল।

*জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা*

*আল-বাত্তানী*  

আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে জাবির ইবনে সিনান আল রাক্কি আল হারানী আস সাবী আল-বাত্তানী। ইনি আব্বাসী সময়কালের একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি হাররান এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন এবং রাক্কা শহরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। আল-বাত্তানী ৭৮৮ থেকে ৯১৮ হিজরী পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তিনি গ্রীক জ্যোতির্বিদ টলেমির কয়েকটি ভুল বর্ণনা করে সেগুলো সংশোধন করেছিলেন।

যেমন- টলেমি বলেছিলেন সালের যে সময়সীমা আছে তা হলো- ৩৬৫ দিন, ৫ ঘন্টা, ৫৫ মিনিট, ১২ সেকেন্ড। কিন্তু আল-বাত্তানী বলেছিলেন যে, সালের সময়সীমা হয়- ৩৬৫ দিন, ৫ ঘন্টা, ৪৬ মিনিট, ২৪ সেকেন্ড।

আল-বাত্তানী পাঁচটি গ্রহের অবস্থা বর্ণনা করেছিলেন। নতুন চাঁদ দেখার পদ্ধতি প্রণয়ন করেছিলেন এবং চন্দ্রগ্রহণের সময়কাল জানার পদ্ধতি বর্ণনা করেছিলেন।

আল-বাত্তানী জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর একাধিক বই লিখেছেন। তন্মধ্যে একটি বিখ্যাত বইয়ের নাম- ‘زيج الصابي’ (যিজুস সাবী)। এই বইয়ের অনুবাদ ল্যাটিন ভাষায় হয়েছিল। এমনকি ইউরোপ দেশের অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী যেমন- ক্যাপলার, কোপারনিকাস ও গ্যালিলিও এই বইয়ের প্রতি প্রবল আগ্রহী ছিলেন। কোপারনিকাস আল-বাত্তানীর এই বই থেকে অনেক উপকৃত হয়েছিলেন।

ভ্যাল ডুরান্ট বলেছিলেন যে, “আল-বাত্তানীর পর্যবেক্ষণগুলি দূরত্ব ও নির্ভুলতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।”

আল-বাত্তানীর পরিষেবা ও অবদানের কারণে তাঁকে ‘আরবদের টলেমি’ (بطليموس العرب) উপাধি দেওয়া হয়েছিল।

*আস সূফী*

আস-সূফীর পূর্ণ নাম আব্দুর রহমান বিন ওমর রাজী। আস সূফী তাঁর উপাধী। তিনি ৯০৩ খ্রীঃ মোতাবেক ২৯১ হিজরীতে রায় শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

             আস সূফী মুসলমানদের একজন মহান্ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন । তিনি টলেমির বই 'আল মাজেস্তি' থেকে অনেক উপকার লাভ করেছিলেন। আস সূফী অনেক তরকা পর্যবেক্ষন করেছিলেন। আর তারকার আবর্তন ও অবস্থান নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, পৃথিবীর গোলাকার। আস সূফী বিভিন্ন তারকার দৈর্ঘ্য-প্রস্থের সীমা বর্ননা করেছিলেন। আস সূফী তারকার গণনাও করেছিলেন। আর অনেক তারকা আবিষ্কার করেছিলেন যা আগে জানা ছিল না। তারপর আকাশের একটি মানচিত্র অঙ্কন করেছিলেন। যার মধ্যে তারকাদের অবস্থা বর্ননা বা নির্দেশনা করেছিলেন। আর তারকার আকৃতি গঠন করেছিলেন। এটি তিনি তারকার রশ্মি বা উজ্জলতা ও আকৃতি দেখে করেছিলেন।


একজন ইংরেজ বিজ্ঞানী লুইস রিচারসন (Louis Richardson) বলেছেন যে, আস-সূফী ফটোমিটার আবিষ্কারের আগে এক হাজারের বেশি তারকার আলোর তীব্রতা বর্ণনা করেছিলেন। তিনি অনেক বই রচনা করেছেন, তন্মধ্যে একটি বিখ্যাত বই হলো- صور الكواكب التابته। তিনি আকাশের মানচিত্র তৈরী করেছিলেন। এছাড়া মানুষ ও প্রাণীদের মতো আকৃতি ছায়াপথের মানচিত্র তৈরী করেছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম বর্ণনা করেছিলেন যে, তারকার রং পরিবর্তন হয়। তিনি তারকার সঠিক গতিবেগ নির্ণয় করেছিলেন। আস-সূফী ইউরোপ দেশে আজুফি (Azophi) নামে পরিচিত ছিলেন। বিশেষত তাঁর অবদানের কারণে একটি চাঁদের নাম ওনার নামে রাখা হয়েছিল। তৎসহ একটি গ্রহের নাম তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছিল- “Azophi 12621”

আস-সূফী বনু বুয়াইয়ার সময়কালে ছিলেন। তিনি ৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দ মুতাবিক ৩৭৬ হিজরীতে সিরাজে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

*ইবনে ইউনুস*

 ইবনে ইউনুসের পূর্ণ নাম- আবুল হাসান আলী বিন আব্দুর রহমান আল-মিসরী। তাঁর পিতা একজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক ছিলেন। তাঁর পিতামহ আহমাদ ইবনে ইউনুস বড় আলিম ছিলেন। ইবনে ইউনুস তৎকালীন সময়ে মিশরের সব থেকে বড় বিজ্ঞানী ছিলেন। মিশরের ফাতেমীয় সম্রাট তাঁর জন্য একটি মানমন্দির তৈরী করেছিলেন। এই মানমন্দির মিশরের ফুসতাত শহরে মুকাত্তম নামক পাহাড়ের উপর অবস্থিত ছিল। ইবনে ইউনুস এই মানমন্দিরে আকাশের বিভিন্ন বস্তু পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তিনি ৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। অতঃপর নিজের বইয়ে সেগুলো খুব ভালোভাবে বর্ণনা করেছিলেন।

ইবনে ইউনুসের একটি অন্যতম কৃতিত্ব হলো- তিনি গ্যালিলিও থেকে ৬০০ বছর আগে দোলকের (Pendulum) উদ্ভাবন করেছিলেন। তিনি দোলককে জ্যোতির্বিদ্যা পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষভাবে ব্যবহার করেছিলেন।

ইবনে ইউনুস অনেক বই লিখেছিলেন। তন্মধ্যে একটি বিখ্যাত বইয়ের নাম- الزيج الكبير الحاكمي (আয-যিজুল কাবীরিল হাকিমী)। তিনি এই বইটা মিশরের ফাতেমীয় খলীফা হাকিম বি-আমরিল্লাহ-এর জন্য তৈরী করেছিলেন। সমস্ত বিজ্ঞানী সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে বিস্তারিত যা বলেছেন তিনি এই বইতে সেই সমস্ত বিস্তারিত তথ্যগুলি লিখেছিলেন। তারপর বইটিকে তাদের লেখার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, চাঁদের গতিবেগ ক্রমাগত বেড়ে যায়। আর এটাই তাঁর গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল।

জ্যোতির্বিদ্যায় ইবনে ইউনুসের অবদানের জন্য একটি চাঁদের নাম তাঁর নামে রাখা হয়েছিল। ইবনে ইউনুস ৩৯৯ হিজরী মুতাবিক ১০০৯ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.