ইন্দো ইসলামী স্থাপত্য কলা ও রীতি বৈশিস্ট্য | ইন্দো মুসলিম স্থাপত্য ~ ইসলাম পরিচয়

ভূমিকা

 

ইন্দো-ইসলামী স্থাপত্য বলতে ভারতীয় উপমহাদেশের এমন স্থাপত্যকে বোঝায় যেগুলো ভারতের মুসলমান শাসকদের দ্বারা তাদের প্রয়োজনে নির্মিত হয়েছে।  সিন্ধু সপ্তম শতাব্দীতে মুসলমান শাসকদের অধীনে গেলেও, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান শাসনের ইতিহাস মূলত মুহাম্মাদ ঘুরির ১১৯৩ সালে দিল্লিকে মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী বানানোর মধ্যদিয়ে শুরু হয়। দিল্লির সুলতান ও মোগল সম্রাটরা মধ্য এশিয়া থেকে আফগানিস্তান হয়ে এসেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে। তারা তাদের নির্মিত স্থাপত্যে ইসলামী স্থাপত্যের মধ্য এশীয় রীতি ব্যবহার করেছিলেন, যা ইরানি ইসলামী স্থাপত্যরীতি থেকে উদ্ভূত।

মুসলিম শাসকদের যে ধরনের ও যে আকারের বড়ো ইময়ারতের প্রয়োজন ছিল, সেগুলো ভারতীয় উপ-মহাদেশে পূর্বে নির্মিত ইমারতগুলো থেকে ভিন্ন। তারা যেসব ইমারত ভারতীয় উপমহাদেশে নির্মাণ করেছিলেন, তন্মধ্যে প্রধান ছিল মসজিদ ও সমাধিসৌধ। মুসলমান শাসকদের হাতধরে নির্মিত ইমারতের বাইরের দিকে ওপরে প্রায়শই বড় গম্বুজের দেখা দেয়। এছাড়া, এসব ইমারতে তোরণের দেখা যায় খিলানের ব্যবহার।

 

ইন্দো-ইসলামী স্থাপত্যরীতিকে শুরুর দিকে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যরীতিকে নিজেদের মত করে আপন করতে হয়েছিল। ইমারতে মানুষের চিত্রায়ন বাদ দেওয়া হয়েছে, যেগুলো হিন্দু মন্দিরের আবশ্যকীয় অঙ্গ। মুসলমান শাসকদের নির্মিত মসজিদ ও সমাধিসৌধে একটি বিশাল ফাঁকা জায়গাত উপরে অনেক বড়ো গম্বুজের দেখা মেলে।

বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় ইসলামী স্থাপত্যরীতিতে ইটের কাজ দেখা গেলেও, ইন্দো-ইসলামী স্থাপত্যরীতিতে ইটের বদলে পাথরকে ইমারতের মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায় কেননা, ভারতীয় কারিগররা পাথর দিয়ে উন্নত মানেত ইমারত নির্মাত জানতেন। দিল্লি কে কেন্দ্র করে ইন্দো-ইসলামী স্থাপত্যরীতি গড়ে উঠলেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানের মুসলমান শাসকদের হাতে এর নানা ধরনের আঞ্চলিক স্থাপত্যরীতি গড়ে ওঠে। মোগল আমলে ইন্দো ইসলামী স্থাপত্যরীতির প্রভাব দেখা যায় হিন্দুদের মধ্যেও। তারা মন্দির নির্মাণে গম্বুজ ও খিলানের ব্যবহার শুরু করে যা আজও বিদ্যমান। বিশেষত, তারা তাদের বসবাসের জন্য ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে গম্বুজ ও খিলান রাখা শুরু করে। এছাড়াও, আধুনিক ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি স্থাপত্যশৈলীতে প্রভাব দেখা যায় ইন্দো-ইসলামী স্থাপত্যের। এছাড়াও, ব্রিটিশদের হাতে ভারতবর্ষে যাত্রা শুরু হওয়া ইন্দো-গোথিক স্থাপত্যরীতির এর প্রভাভ বিদ্যমান। ইন্দো-গোথিক স্থাপত্যরীতির ধর্মীয় ও সাধারণ, সব ধরনের ইমারতেই ইন্দো-ইসলামী স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষ করা যায়। ইন্দো-ইসলামী স্থাপত্যে ভারতীয়, ইসলামী, ইরানি, মধ্য এশীয় ও অটোমান তুর্কি স্থাপত্যের প্রভাব বিদ্যমান। গম্বুজ ও খিলানের ব্যবহার ভারতীয় স্থাপত্যরীতি ও হিন্দু মন্দিরে কিছু দেখা যায়।

 

 

প্রথম অধ্যায়

সালতানাত যুগের স্থাপত্য

 

সুলতানি স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য

সুলতানি যুগের প্রথম পর্বে তুর্কি অভিযানকারীদের ‘ অসভ্য বর্বর ' বলে আখ্যায়িত করার যে প্রবণতা ছিল , তা একেবারে অস্বাভাবিক ছিল না । কারণ যে নৃশংসতা , হত্যাকাণ্ড , লুণ্ঠন ও অত্যাচার দ্বারা তুর্কি যোদ্ধারা ভারত ভূমিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল , তাতে তাদের মধ্যে শিল্পীর উদারতা , সূক্ষ্মতা বা কোমলতার অস্তিত্ব কল্পনা করাও কষ্টকর ছিল । কিন্তু তাই বলে তুর্কো - আফগান জাতি ইসলামীয় শিল্প - সংস্কৃতি সম্পর্কে উদাসীন ছিল – এ কথা ঠিক নয় । ড . কুরেশী দিল্লির সুলতানী রাষ্ট্রকে Cultural state বলে অভিহিত করেছেন । সুলতানি যুগের শাসকরা সাম্রাজ্য বিস্তার ও শাসন পরিচালনার পাশাপাশি শিল্প স্থাপত্যেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেন । তাঁদের উদ্যোগে দিল্লি , আগ্রা ও সন্নিহিত অঞ্চলে বহু দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ , মসজিদ , স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি নির্মিত হয় ।

সুলতানি যুগের স্থাপত্য শিল্প সুলতানি যুগে ভারতে হিন্দু - মুসলিম সংস্কৃতির সমন্ব শিল্প বিকাশ ঘটে । স্যার জন মার্শাল লিখেছেন , হিন্দু ও মুসলমান প্রতিভার মিলনের ফলে সুলতানি আমলে এক নতুন স্থাপত্য শিল্পের উদ্ভব হয় । এই রীতি ইন্দো - সারাসেনিয়া ‘ বা ‘ ইন্দো মুসলিম ' রীতি নামে পরিচিত । এই নতুন শিল্পধারাকে মুসলিম শিল্পরীতির ভারতীয় সংস্করণ কিংবা হিন্দু শিল্পরীতির পরিবর্তিত রূপ বলা ঠিক নয় । প্রকৃতপক্ষে দুটি ধারার মিলনের ফলেই এই উন্নত ও বলিষ্ঠ ধারার উদ্ভব ঘটেছে ।

 

কুয়াৎ-তুল-ইস্‌লাম মস্‌জিদ

দিল্লী জয় করে কুৎবউদ্‌দীন আইবক সর্বপ্রথমে নির্মাণ করলেন জাম-ই-মস্‌জিদ, যার নাম ‘কুওওতুল ইস্‌লাম’মস্‌জিদ। তার অর্থ ইস্‌লামের শক্তি। স্‌জিদের প্ল্যানিং একটি আয়তক্ষেত্র। চিরাচরিত পদ্ধতিতে তার পশ্চিমে মূল উপাসনাগৃহ; পূর্বে একটি গম্বুজের ভিতর দিয়ে রবেশদ্বার। তিন পাশে বারান্দা সারি-সারি স্তম্ভের উপর সমতল ছাদ। ইস্‌লামী স্থাপত্যে যার নাম লিয়ান।

পরবর্তী সুলতান ইল্‌তুৎমিস্ এই মস্‌জিদটি সম্প্রসারিত করেন। তারও পরবর্তী যুগে, বস্তুত পরবর্তী খিল্‌জী বংশের আলাউদ্‌দীন খিল্‌জীর আমলে এই মস্‌জিদটি আরও বড় করে সম্প্রসারিত করা হয়।

 এ মস্‌জিদের সবচেয়ে দর্শনীয় বস্তুটি উপসনা-কক্ষের সম্মুখস্থ খিলান-সমন্বিত প্রাচীর ইস্‌লামী স্থাপত্যে যার অভিধা: মাখ্‌সুরাহ্। কুৎবউদ্‌দীন নির্মিত আদিম মস্‌জিদে আছে পাঁচটি খিলান, কেন্দ্রস্থটি উচ্চতর, দু’পাশে দুটি অপেক্ষাকৃত ছোট। ইল্‌তুৎমিসের সম্প্রসারিত অংশে এক-একদিকে তিন-খিলান-ওয়ালা দুটি মাখ্‌সুরাহ্ এবং আলাউদ্‌দীন খিল্‌জী শুধুমাত্র উত্তরদিকে মস্‌জিদ সম্প্রসারণকালে নির্মাণ করেন পরপর নয়টি খিলান। এর ভিতর আলাউদ্‌দীন-নির্মিত খিলানের চিহ্নমাত্র নেই, ইল্‌তুৎমিস্-মাখ্‌সুরাহ্-র সামান্য ধ্বংসাবশেষ দৃষ্ট হয়; অথচ সর্বপ্রথম-আদিম পাঁচটি তিনটি এখনও অটুট।

আদিম মাখ্‌সুরাহ্-র দৈর্ঘ্য ৩৩ মিটার, গভীরতা ২.৫৬ মিটার এবং ১৫.২৫ উচ্চতা মিটার। কেন্দ্রীয় খিলানের উচ্চতা ১৩.৫ মিটার এবং তার স্প্যান ৬.৬ মিটার। “স্থানীয় স্থপতিরা পশ্চিম-এশীয় আর্কুয়েট (arcuate) প্রথার সঙ্গে পরিচিত না-থাকার ফলে এই খিলানগুলি নির্মাণে ভারত প্রচলিত ট্রাবিয়েট (trabeate) প্রথার প্রয়োগ করেন।”

আড়াই দিন কা ঝোঁপড়া

প্রথম দিককার আরেকটি মসজিদ হল আড়াই দিন কা ঝোঁপড়া। রাজস্থানের আজমিরে অবস্থিত মসজিদটির নির্মাণকাজ ১১৯০ এর দশকে শুরু হয়েছিল। এই ইমারতে একই রকম খিলান ও গম্বুজের দেখা মেলে। ধ্বংসপ্রাপ্ত হিন্দু মন্দিরের স্তম্ভ ব্যবহার করার দরুন ইমারতটি অধিকতর উচ্চতা লাভ করেছিল।মসজিদে দুইটি আলাদা বৃহৎ প্রবেশদ্বার বিদ্যমান। একটি প্রবেশদ্বারের সামনে খিলান ব্যবহৃত হয়েছে। খুব সম্ভবত নির্মাণের দুই যুগ পর ইলতুতমিশের শাসনামলে খিলান যোগ করা হয়েছে। ইমারতটিতে কেন্দ্রীয় খিলান বৃহত্তম, যা আইওয়ানের পরিবর্তিত রূপ। আজমির সামনের দিকের ছোট খিলানকে পরীক্ষামূলকভাবে উপরের দিকে নেওয়া হয়েছে, যা পূর্বে ভারতে দেখা যায় নি।

১৩০০ সালের দিকে আসল গম্বুজ ও খিলানের সাহায্যে ভুস্যার নির্মাণ করা হয়; ধ্বংসপ্রাপ্ত বালবানের সমাধিসৌধ সম্ভবত এর সবচেয়ে পুরাতন নজির।

 

কুতুব মিনার ও স্থাপনাসমূহ

দিল্লির কুতুবমিনার (Qutb Minar) হল এয়োদশ শতকের মুসলিম স্থাপত্যের সবচেয়ে বড় নিদর্শন। সুফি সাধক কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের উদ্দেশ্যে এটি নির্মিত হয়েছিল । কুতুবমিনারের নির্মাণ কার্য শুরু করেন কুতুবউদ্দিন আইবক এবং সম্পূর্ণ হয় ইলতুৎমিসের আমলে। কুতুব মিনার ও স্থাপনাসমূহ দিল্লীর দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত। লাল বেলেপাথরে নিৰ্মিত এই মিনারটির উচ্চতা ৭২.৫ মিটার (২৩৮ ফুট)। মিনারটির পাদদেশের ব্যাস ১৪.৩২ মিটার (৪৭ ফুট) এবং শীৰ্ষঅংশের ব্যাস ২.৭৫ মিটার (৯ ফুট)। ত্ৰয়োদশ শতাব্দীর প্ৰথম দিকে এই মিনারের নিৰ্মাণকাৰ্য সমাপ্ত হয়। মিনার প্ৰাঙ্গনে আলাই দরজা (১৩১১), আলাই মিনার (এটি অসমাপ্ত মিনারের স্তূপ, এটা নিৰ্মাণের কথা থাকলেও, নিৰ্মাণকাৰ্য সমাপ্ত হয়নি), কুব্বত-উল-ইসলাম মসজিদ (ভারতের প্ৰাচীনতম মসজিদসমূহের অন্যতম, যেসব বৰ্তমানে আছে), ইলতোতমিসের সমাধি এবং একটি লৌহস্তম্ভ আছে। একাধিক হিন্দু এবং জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে এই মিনার নিৰ্মিত হয় বলে কথিত আছে। অনুমান করা হয় যে ভারতে ইসলাম শাসনের প্ৰথম দিকে বহিরাগত আক্ৰমণে এই মন্দিরসমূহ ধ্বংসপ্ৰাপ্ত হয়েছিল। প্ৰাঙ্গন কেন্দ্ৰস্থল ৭.০২ মিটার (২৩ ফুট) উচ্চতাবিশিষ্ট যেখানে চকচকীয়া লৌহস্তম্ভ আছে, যেখানে আজপৰ্যন্ত একটুও মরচে ধরেনি। এই লৌহস্তম্ভে সংস্কৃত ভাষায় দ্বিতীয়  চন্দ্ৰগুপ্তের একটা লেখা আছে। ১১৯২ সালে কুতুবউদ্দিন আইবেক এই মিনারের নিৰ্মাণ কাজ আরম্ভ করেছিলেন। ইলতোতমিসের রাজত্বকালে (১২১১-৩৮) মিনারের কাজ শেষ হয়। আলাউদ্দিন খিলজীর রাজত্বকালে (১২৯৬-১৩১৬) এটার প্রাঙ্গণ এবং নির্মাণ নিৰ্মাণকাৰ্য সম্পাদন হয়। পরবৰ্তীকালে বজ্ৰপাতে মিনার ক্ষতিগ্ৰস্থ হয় যদিও তার সংস্কার করা হয়েছিল। ইসলামিক স্থাপত্য এবং শিল্পকৌশলের এক অনবদ্য প্ৰতিফলন হিসাবে ইউনেস্কো 2006 সালে বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকার (iv) বিভাগে এই প্রাঙ্গণ বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মৰ্যাদা লাভ করে।

আলাই দরওয়াজা

আলাই দরওয়াজা হল কুতুব মিনার কমপ্লেক্সের কুওয়াত-উল-ইসলাম মসজিদের দক্ষিণ দিক থেকে প্রধান ফটক। ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি নির্মাণ করেন।

আলাই দরওয়াজায় একটি গম্বুজ বিশিষ্ট প্রবেশদ্বার রয়েছে যা লাল বেলেপাথর ব্যবহার করে নির্মিত এবং সাদা মার্বেল দিয়ে সজ্জিত। আলাই দরওয়াজার দেয়ালে নাশক লিপিতে খোদাই করা আছে।  তুর্কি কারিগরদের দ্বারা নির্মিত আলাই দরওয়াজা ভারতের প্রথম ভবনগুলির মধ্যে একটি যা ইসলামিক স্থাপত্য শৈলী ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছিল।  তার সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত, আলাই দরওয়াজা কুওয়াত-উল-ইসলাম মসজিদের মনোমুগ্ধকর খিলান এবং চৌকাঠের সাথে যোগ করেছে যা পদ্মের কুঁড়ির মতো।

আলাই দরওয়াজার ভিতরের দিকে একটি কক্ষ আছে যার অভ্যন্তর ভাগের দৈর্ঘ্য ৩৪.৫ ফুট এবং বহির্ভাগের দৈর্ঘ্য ৫৬.৫ ফুট। এটি ৬০ ফুট উঁচু এবং এর দেয়াল ১১ ফুট মোটা।

১৩১১ সালের স্থাপনাটিতে প্রযুক্তির সতর্ক ব্যবহার করা হয়েছে কেননা, এর দেয়াল খুব পুরু ও এর গম্বুজ অগভীর যা শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা বা দূরত্ব থেকে দেখা যায়। এছাড়াও, স্থাপনাটিতে লাল বেলেপাথর ও সাদা মার্বেল ব্যবহার করা হয়েছে যার পরবর্তীকালের ইন্দো-ইসলামী স্থাপত্যে দেখা গিয়েছে। স্থাপনার খিলানে হালকা অশ্বখুরাকৃতি খিলানের ছোঁয়া দেওয়া হয়েছে। এর অভ্যন্তরীণ কোণা খাঁজবিশিষ্ট না হলেও এতে প্রচলিত রীতির মত অগ্রমুখী অভিক্ষেপ বিদ্যমান যাতে সম্ভবত পদ্মকুঁড়ির আকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। জালি, পাথর দিয়ে নির্মিত খোলামুখী পর্দা এতে প্রথমবারের মত ব্যবহৃত হয়েছে যা পূর্বে মন্দিরে ব্যবহৃত হতে দেখা গিয়েছে। গম্বুজটির উচ্চতা ৪৭ ফুট। এটি ভারতবর্ষে নির্মিত প্রথম সার্থক গম্বুজ; পূর্বে ভারতবর্ষের স্থাপনায় গম্বুজ তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল তবে তা সফল হয় নি।  পুরো স্থাপনাটি লাল বেলেপাথর দিয়ে নির্মিত যার বাইরের দেয়ালে সাদা মার্বেল ব্যবহৃত হয়েছে। স্থাপনাটির দেয়ালে আরবি ক্যালিগ্রাফি ব্যবহৃত হয়েছে। স্থাপনাটির খিলান অশ্বখুরাকৃতির। এই স্থাপনার মাধ্যমে ভারতবর্ষে প্রথমবারের মত এই ধরনের খিলান ব্যবহৃত হয়েছে। স্থাপনাটির বহির্ভাগে প্রাক-তুর্কি খোদাই ও প্যাটার্ন চোখে পড়ে। স্থাপনাটির জানালায় মার্বেল জাফরি বিদ্যমান। স্থাপনাটির মেঝেতে লতাপাতার নিকশা বিদ্যমান।

তুঘলক স্থাপত্য

 

তুঘলক শাসকদের অধীনের স্থাপত্যবিভাগ ও নির্মাণ বিভাগ ছিল। তারা এই বিভাগদ্বয়ে বহু হিন্দুকে নিয়োগ প্রদান করেছিল। তারা বহু ইমারত ও আধুনিক তুঘলক স্থাপত্য গড়ে তুলেছিল। বলা হয়ে থাকে ১৩৫১ থেকে ১৩৮৮ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করা তুঘলক সাম্রাজ্যের তৃতীয় সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক নিজে বহু ইমারত নির্মাণ করেছিলেন। তিনি তুঘলক সাম্রাজ্যের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন শাসক ও সেরা নির্মাতা ছিলেন। হরিয়ানার হিসারে অবস্থিত তার ফিরোজ শাজ প্যালেস কমপ্লেক্স (১৩৫৪ সালে নির্মাণ শুরু) ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও এর কিছু অংশ এখনো ভাল আছে। তার সময়ে নির্মির ইমারতগুলোর স্থাপত্যকলার মাঝে থাকা বৈশিষ্ট্যগুলো ইসলামী স্থাপত্যকলায় কদাচিৎ দেখা যায় অথবা ইসলামী স্থাপত্যকলার বৈশিষ্ট্য থেকে আলাদা। তিনি দিল্লির হাউজ খাস কমপ্লেক্সে সমাহিত হন। তার আমল ও তুঘলক সালতানাতের পরবর্তী শাসনামলে নির্মিত ইমারতগুলো (গম্বুজওয়ালা ইমারতগুলো সহ) শুধুমাত্র স্তম্ভ অবলম্বন করে নির্মিত হয়েছে।

এই সময়ে ইন্দো-ইসলামী স্থাপত্যে প্রথম দিককার ভারতীয় স্থাপত্যের কিছু উপাদান যুক্ত হয়। যেমন, উঁচু স্তম্ভমূলের ব্যবহার, ইমারতের কোণা ছাড়াও স্তম্ভ ও স্তম্ভের উপরে এবং ছাদে ঢালাইয়ের ব্যবহার।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের মৃত্যুর পর তুঘলক সাম্রাজ্যের স্থাপত্যকলা শ্রীহীন হয়ে পড়ে। তার পরে নির্মিত অধিকাংশ ইমারতগুলো ছিল সমাধিসৌধ। তখন, আঞ্চলিক মুসলিম স্থাপত্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল।

তুঘলাকাবাদ দুর্গ  

 

গিয়াস-উদ-দ্বীন তুঘলকের মাজারটি দুর্গের দক্ষিণ ফাঁড়ি দিয়ে একটি যুক্ত পথের সাথে যুক্ত। এলিভেটেড কোজওয়ে দৈর্ঘ্যে 600 ফুট পর্যন্ত যায় এবং এটি 27 টি খিলান দ্বারা সমর্থিত হয়, একটি কৃত্রিম হ্রদের মধ্য দিয়ে যায়। প্রাচীন পিপাল গাছটি পেরোনোর পরে, গিয়াস-উদ-দ্বীন তুঘলক সমাধি কমপ্লেসে লাল বেলেপাথর থেকে তৈরি একটি প্রবেশ পথ রয়েছে যার দিকে যাওয়ার পথে একটি বিমান ছিল। সমাধিটি প্যারাপেট এবং প্রাচীর সহ বর্গাকার আকারে একটি একক গম্বুজযুক্ত সমাধি দ্বারা তৈরি। পাশগুলিতে মসৃণ লাল রঙের বেলেপাথর রয়েছে এবং খালি প্যানেল এবং মার্বেল খিলান সীমানা যুক্ত রয়েছে। এই আড্ডায় সাদা মার্বেল এবং স্লেট স্ল্যাব দ্বারা আবৃত অষ্টভুজ ড্রামে একটি মার্জিত আকারের গম্বুজ রয়েছে।

সমাধিসৌধের মধ্যে আপনি তিনটি সমাধির সন্ধান পাবেন, যথা একটি কেন্দ্রীয় যা সম্রাটের নিজের এবং দুটি অন্যরা বিশ্বাস করেন যে তাঁর পুত্র মুহাম্মদ বিন তুঘলক এবং স্ত্রীর পক্ষে ছিলেন। খিলানযুক্ত দরজাগুলির উপরে একটি ছোট মার্বেল গম্বুজ এবং খোদাই করা বেলেপাথর এবং মার্বেল স্ল্যাব সহ একই নকশায় আরও একটি অষ্টভুজ সমাধি রয়েছে। শিলালিপি অনুসারে, এই সমাধিতে জাফর খানের মৃতদেহ রয়েছে।

 

 

 

 

দ্বিতীয় অধ্যায়

মোঘল যুগের স্থাপত্য

 

মোঘল যুগের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য

মুঘল স্থাপত্য ইসলামি, পারস্য ও ভারতীয় স্থাপত্যের এক সংমিশ্রণ। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রসারিত মুঘল সাম্রাজ্যে এই স্থাপত্যশৈলীটি বিকশিত হয়ে ওঠে। মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অনেক নিদর্শন ভারত, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে দেখতে পাওয়া যায়।

মুঘল সাম্রাজ্য ভারতবর্ষে ১৫২৬ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছে। মুঘল স্থাপত্য প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যকে ইসলামী, ইরানি, তুর্কি, আরবি, মধ্য এশীয় স্থাপত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। মুঘল স্থাপত্যে ইমারত ও আঙ্গিনার মাঝে ভারসাম্য রাখা হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীর মুঘল সম্রাট আকবর মুঘল স্থাপত্যে নির্মিত দুর্গ ও শহরে মুঘল স্থাপত্যরীতির সাথে ভারতীয় স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণ ঘটান। সেই সময়ে নির্মিত একটি দুর্গের তোরণে অ্যাসিরীয় গ্রিফনের (এক প্রকার কাল্পনিক প্রাণী) পাশাপাশি ভারতীয় হাতি ও পাখির ছবি দেখা যায়।

মুঘল যুগে ইসলামী-ইরানি স্থাপত্যের সাথে সংমিশ্রণ ঘটত ভারতীয় স্থাপত্যের। ফলশ্রুতিতে, তা ভারতীয় স্থাপত্যে নতুন মাত্রা যোগ করে।

 

তাজমহল

 

ভারতের উত্তর প্রদেশে আগ্রায় অবস্থিত একটি রাজকীয় সমাধি। মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম যিনি মুমতাজ মহল নামে পরিচিত, তার স্মৃতির উদ্দেশে এই অপূর্ব সৌধটি নির্মাণ করেন। সৌধটির নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে যা সম্পূর্ণ হয়েছিল প্রায় ১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে।

তাজমহলকে (কখনও শুধু তাজ নামে ডাকা হয়) মুঘল স্থাপত্যশৈলীর একটি আকর্ষণীয় নিদর্শন হিসেবে মনে করা হয়, যার নির্মাণশৈলীতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। যদিও সাদা মার্বেলের গোম্বুজাকৃতি রাজকীয় সমাধিটিই বেশি সমাদৃত, তাজমহল আসলে সামগ্রিকভাবে একটি জটিল অখণ্ড স্থাপত্য। এটি ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল। তখন একে বলা হয়েছিল 'বিশ্ব ঐতিহ্যের সর্বজনীন প্রশংসিত শ্রেষ্ঠকর্ম।'

তাজমহলের মূলে হল তার সাদা মার্বেল পাথরের সমাধি। যা অন্যান্য মুঘল সমাধির মত মূলত পারস্যদেশীয় বৈশিষ্ট্য, যেমন আইওয়ানসহ প্রতিসম ইমারত, একটি ধনুক আকৃতির দরজা, উপরে বড় গম্বুজ রয়েছে। সমাধিটি একটি বর্গাকার বেদিকার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভিত্তি কাঠামোটি বিশাল এবং কয়েক কক্ষবিশিষ্ট। প্রধান কক্ষটিতে মুমতাজ মহল ও শাহজাহানের স্মৃতিফলক বসানো হয়েছে, তাদের কবর রয়েছে এক স্তর নিচে।

সমাধির উপরের মার্বেল পাথরের গম্বুজই সমাধির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এর আকার প্রায় ইমারতের ভিত্তির আকারের সমান, যা প্রায় ৩৫ মিটার। এর উচ্চতা হওয়ার কারণ গম্বুজটি একটি ৭ মিটার উচ্চতার সিলিন্ডার আকৃতির ড্রাম এর উপরে বসানো।

এর আকৃতির কারণে, এই গম্বুজকে কখনো পেয়াজ গম্বুজ অথবা পেয়ারা গম্বুজ বলেও ডাকা হয়। গম্বুজের উপরের দিক সাজানো হয়েছে একটি পদ্মফুল দিয়ে, যা তার উচ্চতাকে আরও দৃষ্টি গোচড় করে। গম্বুজের উপরে একটি পুরনো সম্ভবত তামা বা কাসার দণ্ড রয়েছে যাতে পারস্যদেশীয় ও হিন্দু ঐতিহ্যবাহী অলঙ্করণ রয়েছে।

 

বড় গম্বুজটির গুরুত্বের কারণ এর চার কোণায় আরও চারটি ছোট গম্বুজ রয়েছে। ছোট গম্বুজগুলোও দেখতে বড় গম্বুজটির মতই। এদের স্তম্ভগুলো সমাধির ভিত্তি থেকে ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। ছোট গম্বুজগুলোতেও কাসা বা তামার পুরনো দণ্ড আছে।

লম্বা মোচাকার চূড়া বা গুলদাস্তা ভিত্তি দেয়ালের পাশ দিয়ে উপরে উঠেছে এবং গম্বুজের উচ্চতায় দৃষ্টিগোচর হয়।   পদ্মফুল ছোট গম্বুজ ও গুলদাস্তাতেও রয়েছে।

তাজমহল তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী নকশার উপর, বিশেষ করে পারস্য ও মুঘল স্থাপত্য অনুসারে। নির্দিষ্ট কিছু নকশা তিমুর ও মুঘল ইমারতের মত হুবহু করা হয়েছে। যাদের মধ্যে তিমুরের গুর-ই-আমির, সমরখন্দে মুঘল সাম্রাজ্যের পূর্বসূরি,[৬] হুমায়ূনের মাজার, ইমাদ-উদ-দৌলার মাজার (কখনো ডাকা হয় শিশু তাজ নামে), এবং দিল্লীতে শাহজাহানের নিজের তৈরি দিল্লী জামে মসজিদ। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায়, মুঘল ইমারত পরিমার্জনের এক নতুন স্তরে পৌঁছায়।[৭] যেখানে পূর্ববর্তী মুঘল ইমারতসমূহ তৈরি হয়েছিল লাল বেলে পাথরে, শাহজাহান চালু করেছিলেন সাদা দামি মার্বেল পাথরের প্রচলন।

মিনারগুলোর মূল বেদিকার কোণাগুলোতে রয়েছে- চারটি বড় চৌকি যাদের প্রতিটির উচ্চতা ৪০ মিটারেরও বেশি। মিনারগুলোতেও তাজমহলের প্রতিসমতার ব্যাপারটিই লক্ষ্য করা যায়।

চৌকিগুলো নকশা করা হয়েছে মসজিদের প্রথাগত মিনারের নকশায়, যেখানে মুয়াজ্জিন নামাজের জন্য আযান দেন। প্রতিটি মিনারেরই দুইটি বারান্দা দিয়ে তিনটি সমান উচ্চতায় ভাগ করা হয়েছে। মিনারের একেবারে উপরে শেষ বারান্দা রয়েছে যার উপরে সমাধির ছাতাগুলোর একই রকম একটি ছাতা রয়েছে।

মিনারের ছাতাগুলোতেও একই রকমের কাজ করা হয়েছে যেমনটি করা হয়েছে পদ্মফুলের নকশা করা চূড়াতে। প্রতিটি মিনারই বেদিকার থেকে বাইরের দিকে কিঞ্চিৎ হেলানো আছে যাতে এ মিনার কখনও ভেঙ্গে পড়লেও যেন তা মূল সমাধির উপরে না পড়ে।

তাজমহল দেয়াল ঘেরা আগ্রা শহরের দক্ষিণ অংশের একটি জমিতে তৈরি করা হয়েছিল যার মালিক ছিলেন মহারাজা জয় শিং। শাহজাহান তাকে আগ্রার মধ্যখানে একটি বিশাল প্রাসাদ দেওয়ার বদলে জমিটি নেন। তাজমহলের কাজ শুরু হয় সমাধির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মাধ্যমে। প্রায় ৩ একর জায়গাকে খনন করে তাতে আলগা মাটি ফেলায় হয় নদীর ক্ষরণ কমানোর জন্য। সম্পূর্ণ এলাকাকে নদীর পাড় থেকে প্রায় ৫০ মিটার উঁচু করা সমান করা হয়। তাজমহল ৫৫ মিটার লম্বা। সমাধিটি নিজে ব্যাসে ১৮ মিটার এবং উচ্চতায় ২৪ মিটার।

তাজমহল তৈরি হয়েছে সারা এশিয়া এবং ভারত থেকে আনা বিভিন্ন উপাদান সামগ্রী দিয়ে। নির্মাণ কাজের সময় ১,০০০ এরও বেশি হাতি ব্যবহার করা হয়েছিল নির্মাণ সামগ্রী বহন করে আনার জন্য। আলো-প্রবাহী অস্বচ্ছ সাদা মার্বেল পাথর আনা হয়েছিল রাজস্থান থেকে, ইয়াশ্‌ব্‌- লাল, হলুদ বা বাদামী রঙের মধ্যম মানের পাথর আনা হয়েছেল পাঞ্জাব থেকে। চীন থেকে আনা হয়েছিল ইয়াশ্‌ম্‌- কঠিন, সাধা, সবুজ পাথর, স্ফটিক টুকরা। তিব্বত থেকে বৈদূর্য সবুজ-নীলাভ (ফিরোজা) রঙের রত্ন এবং আফগানিস্তান থেকে নীলকান্তমণি আনা হয়েছিল। নীলমণি- উজ্জ্বল নীল রত্ন এসেছিল শ্রীলঙ্কা এবং রক্তিমাভাব, খয়েরি বা সাদা রঙের মূল্যবান পাথর এসেছিল আরব থেকে। এ আটাশ ধরনের মহামূল্যবান পাথর সাদা মার্বেল পাথরেরে উপর বসানো রয়েছে।

তৎকালীন নির্মাণ খরচ অনুমান করা কঠিন ও কিছু সমস্যার কারণে তাজমহল নির্মাণে কত খরচ হয়েছিল তার হিসাবে কিছুটা হেরফের দেখা যায়। তাজমহল নির্মাণে তৎকালীন আনুমানিক ৩২ মিলিয়ন রুপি খরচ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু শ্রমিকের খরচ, নির্মাণে যে সময় লেগেছে এবং ভিন্ন অর্থনৈতিক যুগের কারণে এর মূল্য অনেক, একে অমূল্য বলা হয়।

 

মোতি মসজিদ

১৭শ শতাব্দীতে লাহোর দুর্গের ভেতর নির্মিত হয়। সম্রাট শাহজাহান এই মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি মার্বেল পাথরে নির্মিত। মসজিদটি লাহোর দুর্গের পশ্চিম পাশে আলমগিরি গেটের কাছে অবস্থিত।

উর্দু ভাষায় মোতি অর্থ মুক্তা। মুঘল সম্রটরা বিভিন্ন মসজিদ রত্নের নামে নামকরণ করতেন। মোতি মসজিদ তন্মধ্যে অন্যতম।

মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতির পর শিখ শাসক রণজিৎ সিঙের সময় এই মসজিদটি জোরপূর্বক একটি শিখ মন্দিরে রূপান্তরিত করা হয় এবং নাম দেয়া হয় মোতি মন্দির। রণজিৎ সিং পরে মসজিদকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশরা পাঞ্জাব দখল করে নিলে মূল্যবান পাথর বস্তাবন্দী অবস্থায় পাওয়া যায়। পরবর্তীতে স্থাপনাটি পুনরায় মসজিদ হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়।

মসজিদটি শাহজাহানের সময়কার মুঘল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত হয়েছে। এটি সম্পূর্ণরূপে মার্বেল নির্মিত।

 

বাদশাহী মসজিদ

পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরে একটি মুঘল যুগের মসজিদ।এটি পাকিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ এবং পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম মসজিদ।ষষ্ঠ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৭১ সালে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন এবং ১৬৭৩ সালে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এই মসজিদ সৌন্দর্যের দিক থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের স্মৃতি বহন করে। পাকিস্তানের লাহোরের ইকবাল পার্কে অবস্থিত মসজিদটি একটি অন্যতম প্রধান পর্যটক আকর্ষণকারী স্থান।

মসজিদটি ১৬৭১ সালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব দ্বারা চালু করা হয়েছিল, সম্রাটের পালক ভাই এবং লাহোরের গভর্নর মুজফফর হুসেন - যিনি ফিদাই খান কোকা নামেও পরিচিত। মারাঠা রাজা ছত্রপতি শিবাজির বিরুদ্ধে তাঁর সামরিক অভিযানের স্মরণে আওরঙ্গজেব মসজিদটি তৈরি করেছিলেন। নির্মাণের মাত্র দুই বছর পর, মসজিদটি ১৬৭৩ সালে খোলা হয়।

পশ্চিমের প্রবেশদ্বার হিসেবে, এবং বিশেষ করে পারস্য, লাহোর একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক শৈলী ছিল যা পারস্য স্থাপত্য শৈলী দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিল। আগে মসজিদ, যেমন ওয়াজির খান মসজিদ, জটিল কাশী কারি, বা কাশান শৈলী টালির কাজ শোভিত ছিল, যা থেকে বাদশাহী মসজিদ চলে যাবে। আওরঙ্গজেব দিল্লির জামা মসজিদের জন্য শাহ জেহানের পছন্দের অনুরূপ একটি স্থাপত্য পরিকল্পনা বেছে নিয়েছিলেন, যদিও বাদশাহি মসজিদটি অনেক বড় আকারে নির্মিত হয়েছিল। উভয় মসজিদে সাদা মার্বেল ইনলে সহ লাল বেলেপাথর রয়েছে, যা লাহোরের সাধারণ মসজিদের নকশা থেকে একটি প্রস্থান, যেখানে জটিল টালির কাজের মাধ্যমে সাজসজ্জা করা হয়।

মসজিদ কমপ্লেক্সের প্রবেশপথ লাল বালুপাথর দিয়ে নির্মিত একটি দ্বিতল ভবন দিয়ে যা এর প্রতিটি সম্মুখভাগে ফ্রেমযুক্ত এবং খোদাই করা প্যানেল দিয়ে বিস্তৃতভাবে সজ্জিত। ভবনটিতে একটি মুকারনা রয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের একটি স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য যা নিকটবর্তী এবং অলঙ্কৃত ওয়াজির খান মসজিদ নির্মাণের সাথে মুঘল স্থাপত্যে প্রথম প্রবর্তিত হয়েছিল।

মসজিদের পুরো নাম "মসজিদ আবুল জাফর মুহি-উদ-দিন মোহাম্মদ আলমগির বাদশা গাজি" যা প্রবেশপথের উপরে মার্বেলে লেখা। মসজিদের প্রবেশদ্বারটি পূর্ব দিকে লাহোর দুর্গের আলমগিরি গেটের দিকে মুখ করে, যা ঔরঙ্গজেব দ্বারা ও চালু করা হয়েছিল। বিশাল প্রবেশদ্বার এবং মসজিদএকটি প্লিন্থে অবস্থিত, যা মসজিদের প্রধান গেটে ২২ ধাপের একটি ফ্লাইট দ্বারা আরোহণ করা হয়। গেটওয়ের বেশ কয়েকটি কক্ষ রয়েছে যা জনসাধারণের কাছে উন্মুক্ত নয়। বলা হয়, একটি কক্ষে নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তার জামাই আলীর চুল রয়েছে।

১৯৯৩ সালে বাদশাহী মসজিদ ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে একটি অস্থায়ী তালিকায় রয়েছে।

 

জামে মসজিদ

দিল্লিতে অবস্থিত ভারতের অন্যতম বৃহত্তম একটি মসজিদ। সাধারণভাবে এই মসজিদটি জামে মসজিদ নামে পরিচিত।আসলে এই মসজিদটির নাম মসজিদ-ই জাহান-নুমা।

মূঘল স্থাপত্য রীতি অনুসারে এই মসজিদটিও লালবেলেপাথর ও মার্বেল তৈরি করা হয়েছে।

মুঘল সম্রাট শাহজাহান ১৬৪৪ থেকে ১৬৫৬ সালের মধ্যে মুঘল রাজধানী, শাহজাহানাবাদে (দিল্লীর পূর্ব নাম) এই মসজিদটি তৈরি করেন এবং মসজিদটির প্রথম ইমাম, সৈয়দ আব্দুল গফুর শাহ বুখারী মসজিদটির উদ্ভোধন করেন। ১৮৫৭ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত এটি ছিল সাম্রাজ্যের প্রধান মসজিদ। মসজিদটি ভারতে ইসলামিক শক্তি এবং ঔপনিবেশিক শাসনে প্রবেশের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত ছিল। ব্রিটিশ শাসনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এটি রাজনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি এখনও চালু আছে এবং এটি দিল্লির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর একটি, যা যার পরিচিতি পুরান দিল্লির সাথে মিশে আছে।

মসজিদটির নকশা করেন স্থপতি, উস্তব খলিল এবং এর নির্মাণে প্রায় ৫০০০ জন শ্রমিক কাজ করেন। এ নিমার্ণে তুর্কি, আরব, পারস্য এবং ইউরোপ সহ বিভিন্ন দেশের মানুষ কাজ করেন। এ নির্মানের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন শাহজাহান এর উজির (বা প্রধান মন্ত্রী), সাদুল্লাহ খান এবং শাহজাহান এর পরিবারের হিসাবাধ্যক্ষ, ফজিল খান। সে সময় অনুযায়ী, নির্মাণ করতে প্রায় ১০ লাখ (১ মিলিয়ন) রুপি খরচ হয়।  ১৬৫৬ সালের জুলাই মাসের ২৩ তারিখে উজবেকিস্তানের বুখারি থেকে আগত সৈয়দ আব্দুল গফুর শাহ বুখারি মসজিদটির উদ্ভোধন করেন।

শাহজাহান এর নতুন রাজধানী শাহজানাবাদের এর অংশ হিসেবে জামে মসজিদ তৈরি হয়। এটি মূঘল শাসনামলে নির্মিত মসজিদগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম হিসেবে বিবেচিত এবং মার্বেল ও চুনাপাথরের সর্বোত্তম মিশ্রণ। নির্মাণের সময়ে ভারতীয় উপমহাসাগরে এটিই ছিল বৃহত্তম মসজিদ। শাহজাহান বলেন যে, মসজিদটি ফাতেহপুর সিকরির জামে মসজিদের নকশা অনুসরণে তৈরি করা হয়। এ বিষয়টি মসজিদটির বাহিরের সম্মুখভাগ এবং উঠান লক্ষ্য করা যায়। মসজিদটির ভেতরের অংশের সাথে আগ্রার জামে মসজিদের অধিক সাদৃশ্য রয়েছে। মসজিদটিতে লাল বেলেপাথর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে এবং আগের মসজিদগুলোর তুলনায় এটিতে অধিক সাদা মার্বেল ব্যবহার করা হয়েছে। এটি সাজাতে কালো মার্বেলও ব্যবহার করা হয়েছে। এর বিভিন্ন দেয়ালে ধমীয় ও প্রসংশামূলক সহ বিভিন্ন বিষয়ক আরব এবং ফার্সি ভাষার লিপির অংশ সাজানো আছে।

পাহাড়ের উপর নির্মিত হওয়ায় মসজিদটি শহরের তুলনায় ১০ মিটার উঁচু একটি স্তম্ভমূলের উপর অবস্থিত। মসজিদটি এমনভাবে নির্মিত যে, এর পেছনের দেয়ালের মুখ পশ্চিম দিকে, মক্কার দিকে। একটি কলেজ, ঔষধালয় এবং মাদ্রাসা মসজিদটির সাথে সংলগ্ন ছিল। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে সেগুলো ধ্বংস হয়ে যায়।

মসজিদের গম্বুজগুলোর দুই পাশে দুটি মিনার রয়েছে, যার একটি উত্তর-পূর্ব এবং অন্যটি দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত। সেগুলো ৪ মিটার উঁচু এবং অনুদৈর্ঘ্য বরাবর সাদা মার্বেল দিয়ে সজ্জিত। প্রতিটি মিনার ১৩০ পায়ের সমান দূরত্ব নিয়ে গঠিত এবং এর আশেপাশে ৩টি স্থানে দর্শন গ্যালারি আছে। প্রতিটি মিনারের উপরে একটি করে মার্বেলের তৈরি চাত্রী আছে।

মসজিদটির বেলেপাথরের তৈরি ৩টি প্রবেশ পথ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো ৩ তলা উচ্চতাবিশিষ্ট পূর্ব প্রবেশ পথ, যা ইতিহাসে রাজকীয় ব্যাক্তিদের প্রবেশ পথ হিসেবে ব্যবহার হতো এবং তা সম্রাট এবং তার সাথে জড়িত ব্যাক্তিদের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত ছিল। দুই তলা উচ্চতাবিশিষ্ট দক্ষিণ প্রবেশ পথটি সাধারণ মানুষ ব্যবহার করত। প্রতিটি প্রবেশ পথের ৩ পাশে বেলেপাথরের সিঁড়ি আছে। সেখানে সাদা কিছু চিহ্ন ছিল, যা প্রার্থনাকারীদের প্রার্থনার দিক নির্ধারণে সহায়তা করত।উত্তর প্রবেশ পথের ক্যাবিনেটে মুহাম্মদ এর অবশেষের একটি সংগ্রহশালা আছে, যার মধ্যে রয়েছে: হরিণের চামড়ায় লিখিত কুরআন, মুহাম্মদ এর দাড়ির একটি চুল, তার জুতা এবং মার্বেলের আবরণের উপর তার পায়ের ছাঁপ আছে

 

লালকেল্লা

মোঘল সম্রাট শাহজাহান অনেক দিন ধরে ভাবছিলেন তার রাজধানী আগ্রা থেকে স্থানান্তর করার জন্য। সভাসদদের পরামর্শ মোতাবেক তিনি সিদ্ধান্ত নেন আগ্রা থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে তা দিল্লীতে প্রতিষ্ঠা করবেন। তার জন্য দরকার সম্রাটের বাসস্থান নির্মাণ। কারণ এখান থেকেই তো তাকে ভারত উপমহাদেশের এই বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করতে হবে। তাই ডাক পড়লো মোঘল সাম্রাজ্যের দুই প্রতিষ্ঠিত স্থাপত্যশিল্পী ওস্তাদ আহমেদ ও ওস্তাদ হামিদের। তাদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হলো সম্রাটের বাসস্থান এমনভাবে নির্মাণের যার দুটি প্রবেশ পথ থাকবে এবং এই প্রবেশ পথ ভারতীয় উপমহাদেশের দুটি প্রধান শহরের দিকে মুখ করে থাকবে। অর্থাৎ প্রবেশ পথের একটি হবে লাহোরের দিকে এবং অন্যটি দিল্লীর দিকে মুখ করে। সম্রাটের নির্দেশনা মতো কাজে নেমে পড়লেন এই দুই স্থাপত্যশিল্পী।

 ১৬৪৮ সাথে এই কেল্লা নির্মাণের কাজ শেষ হয়। এর জন্য সময় লেগেছিল প্রায় দশ বছর। পুরনো দিল্লীর যমুনা নদীর তীরে সম্রাটের জন্য নির্মিত হয় এক নতুন রাজকীয় ভবন। সেই সাথে প্রতিষ্ঠিত হয় সম্রাট শাহজাহানের নতুন রাজধানী।

লালকেল্লার আয়তন আগ্রা দুর্গের দ্বিগুণ। এর পূর্বদিকে যমুনা নদী এবং পশ্চিমে পরিখা। দুর্গের চারটি বড়ো দরজা, দুটি ছোটো দরজা ও একুশটি বুরুজ ছিল। দুর্গের মধ্যে একভাগে ছিল রাজপরিবারের বাসস্থান, অন্য দিকে বিভিন্ন দপ্তর। সেই সময়ে ৯১ লক্ষ টাকা খরচ করে এটি বানানো হয়েছিল। দুর্গ ও শহরের মধ্যে নালা দিয়ে সেকালে জল বয়ে যেত। এই জলবাহী নালাগুলোকে বলা হতো ‘নেহর-ই বিহিশত' (স্বর্গের খাল)। ইসলামি রীতি অনুযায়ী এগুলোকে সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধির প্রতীক ভাবা হতো।

লালকেল্লার অলংকরণ ও শিল্পকর্ম অতি উচ্চমানের। পারসিক, ইউরোপীয় ও ভারতীয় শিল্পকলার সংমিশ্রণে সৃষ্ট এই অভিনব শিল্পকলা ব্যঞ্জনাময়, বর্ণময় এবং স্বতন্ত্রতার দাবিদার। দিল্লির লালকেল্লা ভারতের সেই সকল স্থাপনাগুলোর অন্যতম যার সঙ্গে ভারতীয় শিল্পের যোগ ঐতিহাসিকসূত্রে গ্রথীত। স্থাপত্যসৌন্দর্যের বিচারেও এই দুর্গটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে ১৯১৩ সালে লালকেল্লা জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন স্থাপনা রূপে ঘোষিত হয় এবং সরকার কেল্লার রক্ষণাবেক্ষণের ভার স্বহস্তে গ্রহণ করে।

দুর্গের প্রাচীর মসৃণ এবং দৃঢ়। দুর্গের দুটি প্রধান দরজা : দিল্লিগেট ও লাহোরগেট। লাহোরগেট হল প্রধান দরজা। এই গেট দিয়ে ঢুকলে একটি লম্বা আচ্ছাদিত বাজারপথ পড়ে। এর নাম চট্টাচক। এই পথের দু দিকের দেওয়াল দোকানের মতো করে স্টল দিয়ে সাজানো। চট্টাচক ধরে সোজা এলে উত্তর-দক্ষিণ পথ পাওয়া যায়। এই পথটি আসলে দুর্গের পশ্চিমের সামরিকক্ষেত্র ও পূর্বের রাজপ্রাসাদের সীমানা। এই পথের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দরজাটিই হল দিল্লিগেট।

লালকেল্লা পুরনো দিল্লির সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। প্রতিবছর সহস্রাধিক পর্যটক এই কেল্লাটি দেখতে আসেন। এই কেল্লার প্রাঙ্গনেই প্রতি বছর ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। লালকেল্লা পুরনো দিল্লির বৃহত্তম স্থাপনাও বটে। বর্তমানে সন্ধ্যায় লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’র মাধ্যমে কেল্লায় মুঘল ইতিহাসের প্রদর্শনী করা হয়। এখানে ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে শহিদদের স্মৃতিতে একটি জাদুঘরও রয়েছে। এই জাদুঘর ছাড়াও রয়েছে একটি পুরাতাত্ত্বিক জাদুঘর ও একটি ভারতীয় যুদ্ধস্মারক সংগ্রহালয়।

২০০৭ সালে লালকেল্লা ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে নির্বাচিত হয়।

আগ্রা দুর্গ

 

ঐতিহাসিক আগ্রা দুর্গটি ভারতের আগ্রায় অবস্থিত। এর নান্দনিক সৌন্দর্য এখনও মানুষকে মুগ্ধ করে। গ্রা দুর্গ বা আগ্রার লালকেল্লা ভারতীয় উপমহাদেশের শাসক মোঘল রাজবংশের রাজকীয় আবাস্থল এবং মোগল স্থাপত্যের এক অনবদ্য নিদর্শন। আগ্রা দুর্গটি ১৯৮২ সালে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এর অর্ন্তভুক্ত। আগ্রা দুর্গটি ভারতের একটি রাজ্য উত্তর প্রদেশের আগ্রার যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত। এটি দেখে বিশ্বের সব দেশের পর্যটকরা মুগ্ধ হয়ে যান। আগ্রা দুর্গ রাঙা বেলেপাথরের তৈরি। দুর্গের প্রাঙ্গণের আয়তন ২.৫ কি.মি.। বর্তমান দুর্গটির অধিকাংশই মোঘল আমলে নির্মিত হলেও এখানে ১১ শতকে নির্মিত একটি প্রাচীন দুর্গের অবস্থান ছিল। ১৪৭৫ সালে আগ্রা ফোর্ট ছিল রাজা বাদল সিং এর অধীনে ইষ্টক নির্মিত একটি সামরিক দুর্গ। যার নাম ছিল বাদলগড়। ইতিহাসে ১০৮০ সালে সর্বপ্রথম এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৫২৬ সালে দিল্লী জয়ের পর সম্রাট বাবর আগ্রা দুর্গে অবস্থান করেন। আগ্রা দুর্গের অপূর্ব নির্মাণ শৈলী দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। দুৰ্গটির অভ্যন্তরে অনেক প্ৰাসাদ, মিনার এবং মসজিদ আছে। এসব ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্ৰথমাৰ্ধের মধ্যবৰ্তী সময়ে নিৰ্মিত হয়। ১১ শতকে নির্মিত একটি প্রাচীন দুর্গের সম্প্রসারণ হিসাবে এর নিৰ্মাণকাৰ্য ষোড়শ শতাব্দীতে আকবর এর রাজত্বকালে আরম্ভ হয় এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে ঔরঙ্গজেব এর রাজত্বকালে শেষ হয়। জাহাঙ্গীর এবং শাহজাহান এর রাজত্বকালে দুৰ্গের বহু নতুন স্থাপনা নিৰ্মিত হয়েছিল। দুৰ্গ-অভ্যন্তরে উল্লেখযোগ্য দৰ্শনীয় স্থানসমূহ হল - খাস মহল, শীশ মহল, মুহাম্মান বুৰ্জ (এটি অষ্টভূজাকৃতির মিনার), দেওয়ান-ই-খাস, দেওয়ান-ই-আম, এবং নাগিনা মসজিদ। এই স্থাপনাসমূহে তিমুরিদ পারসিকশিল্পকলা এবং ভারতীয় শিল্পকলার এক আশ্চৰ্য মিশ্ৰণ পরিলক্ষিত হয়কেল্লাটি ১৯৮২ সালে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে (iii) নং বিভাগে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তৰ্ভুক্ত হয়। দুৰ্গটি ভারতের একটি রাজ্য উত্তর প্রদেশের আগ্রার যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত। 

বুলন্দ দারওয়াজা

 

বিশ্বের উচ্চতম এই দরজা ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের ফতেপুর সিকরিতে অবস্থিত। ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল বাদশা আকবর এটি তৈরি করেন। বুলন্দ শব্দের অর্থ মহান বা উচ্চ। অর্থাৎ এর অর্থ 'মহান দ্বার'। গুজরাট জয় উপলক্ষে সম্রাট আকবর এটি নির্মাণ করেন। আগ্রা থেকে ৪৩ কিমি দূরে অবস্থিত ফতেপুর সিক্রি মহলের প্রবেশের এটিই মূলদ্বার। অপর দ্বারটির নাম বাদশাহী দরওয়াজা।

এই দরজার কাঠামোটি লাল ও হলুদ বেলেপাথরে নির্মিত। এর গায়ে আবার সাদা কালো মার্বেল দিয়ে নকশা করা আছে। এটি মাটি থেকে প্রায় ৫৪ মিটার লম্বা। দরজা পর্যন্ত পৌঁছোতে ৪২ টি সিঁড়ির ধাপ উঠতে হয়। দরজার পাল্লাগুলিতে কাঠের কারুকার্য করা আছে। দরজার মাথায় একসারি প্যারাপেট আর তার পিছনে তিনটে ছত্রী রয়েছে। দরজার ওপরের ছাদে সামিয়ানা হিসেবে হয়তো এগুলো ব্যবহৃত হত। খিলানটিতে মূলত তিনটি দ্বার বর্তমান, যেগুলোর গায়ে কারুকার্য করা এবং এর ওপরে তিনটি করে দ্বারমুখ করা।

দরজার পুবদিকের খিলানের গায়ে পার্সিলিপিতে আকবরের গুজরাট জয়ের কথা লেখা। মুঘল স্থাপত্যে তৈরী মূল খিলানটির গায়ে লেখা লিপি থেকে আকবরের উদার ধর্মনীতির পরিচয় পাওয়া যায়। মূল দ্বারটির গায়ে খোদাই করা লেখাটির অর্থ হল , হযরত ঈশা বলেছেন,পৃথিবী একটা সেতুমাত্র। এর ওপর দিয়ে পার হয়ে যাও কিন্তু এখানে স্থায়ী বাসা বাঁধতে যেয়ো না। কেউ হয়তো অনন্তকাল এখানে থাকতে চায়, কিন্তু এই জীবন এক ঘণ্টার বেশি স্থায়ী নয়। তাই বাকি জীবনটা ঈশ্বরের প্রার্থনায় কাটাও। কুরআনের কিছু আয়াত এর গায়ে খোদাই করা আছে। শেখ সেলিম চিস্তির শিষ্য খাজা হুসেন চিস্তি সেগুলি খোদাই করেছিলেন।

 

উপসংহার

 

 

পরিশেষে বলা যায় যে কুতুবউদ্দিন আইবকের হাত ধরে যে ইন্দো - ইসলামীয় স্থাপত্যের সূচনা তা লোদী শাসনকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। সুলতানি আমলের টিকে থাকা সৌধের চেয়ে মুগল আমলের বিদ্যমান সৌধের সংখ্যা অনেক বেশি। নির্মাণকালের নৈকট্য , নির্মাণ সামগ্রীর স্বল্পমূল্য এবং নির্মাণের সহজ কলাকৌশলই এর কারণ । নির্মাণের সরল পদ্ধতি ও ব্যয়স্বল্পতার কারণে এই নির্মাণরীতি সারা ভারতে ব্যাপক প্রসারলাভ করে এবং রাজধানী থেকে দূরে কর্মরত মুগল কর্মকর্তারাই শুধু নন, জনকল্যাণে অবদান রাখতে আগ্রহী জমিদাররাও এই নির্মাণরীতি অনুসরণে এগিয়ে আসে। গ্রামাঞ্চলের মসজিদের অধিকাংশই বর্গাকৃতি ও এক গম্বুজবিশিষ্ট এবং এই ঐতিহ্য অদ্যাবধি অনুসৃত হয়ে আসছে।

 ইন্দ-ইসলামী স্থাপত্যরীতিকে শুরুর দিকে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যরীতিকে নিজেদের মত করে আপন করতে হয়েছিল। বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের ইসলামী স্থাপত্যরীতিতে ইটের ব্যবহার দেখা গেলেও , ইন্দো ইসলামী স্থাপত্যরীতিতে ইটের পরবর্তী পাথরকে ইমারতের মূল উপাধান হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায় কেননা , ভারতীয় কারিগররা পাথর দিয়ে উন্নত মানেত ইমারত নির্মাত করতে জানতেন । দিল্লি কে কেন্দ্র করে ইন্দো - ইসলামী স্থাপত্যরীতি গড়ে উঠলেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানের মুসলমান শাসকদের হাতে এর নানা ধরনের আঞ্চলিক স্থাপত্যরীতি গড়ে ওঠে । মোগল আমলে ইন্দো ইসলামী স্থাপত্যরীতির প্রভাব দেখা যায় হিন্দুদের মাঝেও । তারা মন্দির নির্মাণে গম্বুজ ও খিলানের ব্যবহার শুরু করে । বিশেষত , তারা তাদের বসবাসের জন্য ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে গম্বুজ ও খিলান রাখা শুরু করে । এছাড়াও , আধুনিক ভারতীয় , পাকিস্তানি , বাংলাদেশি স্থাপত্যশৈলীতে প্রভাব দেখা যায় ইন্দো - ইসলামী স্থাপত্যের । এছাড়াও , ব্রিটিশদের হাতে ভারতবর্ষে যাত্রা শুরু হওয়া ইন্দো - গোথিক স্থাপত্যরীতির এর প্রভাভ বিদ্যমান । ইন্দো - গোথিক স্থাপত্যরীতির ধর্মীয় ও সাধারণ , সব ধরনের ইমারতেই ইন্দো - ইসলামী স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষ করা যায় । ইন্দো - ইসলামী স্থাপত্যে ভারতীয় , ইসলামী , ইরানি , মধ্য এশীয় ও অটোমান তুর্কি স্থাপত্যের প্রভাব বিদ্যমান ।


 

 

গ্রন্থ পঞ্জিকা

 

১) BANGLA EDUCATION,  সুলতানী যুগের স্থাপত্য শিল্প ও চিত্রকলা,” তথ্য সংগ্রহ জুন ২০, ২০২২

২) Biswas, Prof. Shipra. History of India. Noida: VIKAS® PUBLISHING HOUSE PVT. LTD. 2016) 12-13

3) Shah, Bipin “story of Qutub Minar of Delhi,” academia.edu, 5

4) Housing News. তুঘলাকাবাদ দুর্গ দিল্লি: শক্তিশালী তুঘলক রাজবংশের একটি নিদর্শন,” শেষ সংশোধন মে ১২, ২০০২১, 

5) মোরসেলিন, সেখ মহঃ। ভারতের ইতিহাস । কলকাতা: স্টুডেন্টস ওয়েজ, ২০১৪ ।

৬) মোস্তফা, গোলাম ।  ইতিহাস ২য় পত্র,। ঢাকা: লেকচার পাবলিকেশন্স লি. ২০২০ ।

৭) এই সময়, আয় মহন্তেশ বাতাকুরকি, “বিশ্বের সপ্তমাশ্চর্যকে ঘিরে রয়েছে এরকম অনেক অদ্ভুত ঘটনা!,” 

8) Mujahid,  Beenish. “History of Mosque Architecture in Lahore,” Journal of Islamic Thought and Civilization, 4 (2014): 30.

9) Aziz, Sadia. “Mosque, Memory and State: A Case study of Jama Masjid(India)and the Colonial state c. 1857.” The Polish Journal of Aesthetics’ 47(2017): 16-17.

10) roarmedia. “দিল্লী জামে মসজিদ,” শেষ সংশোধন আগস্ট ২৭,২০২০,

১১) আলাপন ব্লগ , লাল কেল্লা,” শেষ সংশোধন  ডিসেম্বর ৩০,২০২১,

১২) উইকিপিডিয়া, “লাল কেল্লা,” , শেষ সংশোধন জুন ১৪,২০২২,০৩:১২

১৩) Jago news24.com, “ঐতিহাসিক আগ্রা দুর্গ,” শেষ সংশোধন জানুয়ারি ১২, ২০১৮

১৪) “বুলন্দ দরওয়াজা,” উইকিপিডিয়া, শেষ সংশোধন ফেব্রুয়ারি ২৮,২০২২ , ০৬:৪৫

 



কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.