কফি আবিষ্কার, প্রচার ও প্রসারে মুসলমানদের অবদান ~ ইসলাম পরিচয়

 কফি আবিষ্কার, প্রচার ও প্রসারে মুসলমানদের অবদান

 

  পৃথিবীতে মানবজাতির অনেক আগে থেকেই কফি গাছের আগমন। ইথিওপিয়ার ২ কিলোমিটার অধিক সুউচ্চ মালভূমির উপরের জঙ্গলে, বন্য কফি গাছ হাজার হাজার বছর আগে থেকেই ছিল। জঙ্গলের পশুপাখি শুধু এই কফি ফল খেত । মানবজাতি এই কফির গুনাগুন আর পান করার প্রক্রিয়া জানতোনা। ইথিওপিয়ান বন্য গাছের গোটা থেকে কফি কিভাবে জনপ্রিয় পানীয় হয়ে উঠলো, আজ সেই ইতিহাস শুনবো। সেই সাথে কফি পান করার প্রক্রিয়া আবিষ্কার এবং পৃথিবীবেপী কফির প্রচার আর প্রসারে মুসলিমদের অসাধারণ অবদানের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।  

লেখক : Julfikar Rijon (Copy without credit Not Allowed)


ইথিওপিয়ান সম্রাজ্য (Aksumite Empire) অর্থাৎ আবিসিনিয়া , ৫২৫ সালে ইয়ামেন দখল করে নেয়। ওই সময়ে ইথিওপিয়ান সম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ চলছে। ইথিওপিয়া, সুদান , ইয়েমেন পর্যন্ত সুবিস্তর ইথিওপিয়ান সম্রাজ্য, আসে পাশের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো। ইয়ামেনে ইথিওপিয়ান সম্রাজ্যের গভর্নর আব্রাহা ৫৭০ সালে মক্কা আক্রমণ করে বিশাল এক হাতির বাহিনী নিয়ে। ওই বছরকে 'আম -আল-ফিল ' অর্থাৎ হাতির বছর বলা হয়,ওই বছরই আমাদের নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা:) জন্ম গ্রহণ করেন।  


কফি আবিস্কারের ইতিহাস



ইসলামের আবির্ভাবের পর মক্কায় নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য ৬১৫ সালে, অনেক সাহাবী ইথিওপিয়ান সম্রাজ্য অর্থাৎ আবিসিনিয়ায় আশ্রয় নেয়। ৬৪৬ সালের মধ্যে রাশেদুন খেলাফতের মুসলিম বাহিনি ইজিপ্ট সহ লৌহিত সাগরের আসে পাশের সকল এলাকা দখল করে ফেলে।  

পূর্বের ইথিওপিয়ান সম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রিত বন্দরনগরী এখন আরবদের নিয়ন্ত্রণে। এসময় অনেক আরব ব্যবসায়ী বাণিজ্য করতে , অনেকে আবার গরু, ছাগল, দুম্বা, ভেড়ার ফার্ম করতে ইথিওপিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে।  


  খালিদ নামের একজন আরব রাখাল , যেকিনা ইথিওপিয়ার পাহাড়ী উপত্যাকার বিস্তর জমিতে ছাগল চরাত। ওই রাখাল একদিন লক্ষ্য করলেন , পাশের ঝোপের এক বিশেষ গাছের পাকা লাল গোটা খেয়ে তার ছাগল চাঙ্গা হয়ে লাফাতে থাকে। বেপারটা অনুসন্ধান করতে ওই রাখাল নিজেই ওই গাছের গোটা (চেরি ) খেলেন। লক্ষ করলেন তার শরীরে শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে আর চাঙ্গা আর তাজা লাগছে। সেই রাতে ঘুম আসছিলোনা। খালিদ তখন ওই গাছের কয়েকটি পাকা চেরী নিয়ে স্থানীয় সুফী শেইখ এর কাছে গেলেন এবং তার আবিষ্কারের কথা বললেন।  


সুফী শেইখ তখন পাকা চেরী পাশের জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দিয়ে তা খেতে নিষেদ করলেন। আগুনে কফি চেরী পুড়ে একটা সুগন্ধ বের হয়ে আসলো।  

পরবর্তীতে কফি চেরীর বিন কড়াইয়ে ভেজে, জাঁতায় পিষে গুঁড়া করে গরম পানির সাথে মিশিয়ে পান করা শুরু করে। আজো ইথিওপিয়ানরা এভাবে কফি পান করে। 

 যদিও কফির উৎপত্তি স্থান ইথিওপিয়া , ইথিওপিয়ার খ্রীষ্টান চার্চ এবং ইথিওপিয়াতে খ্রীষ্টান সম্রাটরা ২০ শো শতাব্দী পর্যন্ত খৃষ্টানদের কফি পান করা নিষিদ্ধ করে রেখেছিলো , কারণ তারা কফিকে ঈশ্বরের দ্বারা অভিশপ্ত মুসলিমদের পানীয় মনে করতো।  

এই কফির প্রচলন ইয়েমেন এবং দক্ষিণ আরবের সব জায়গায় ছড়িয়ে যায় ৭ শো সালের শেষের দিকে। আরবরা কফির বিন কে বার্ন বলতো, কারণ ইউথপিয়ানটাও বার্ন বলতো।  

কফি শব্দটা কোথায় থেকে আসলো এটা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। সবচেয়ে বহুপ্রচলিত ব্যাখ্যা হলো , ইথিওপিয়ার যে অঞ্চল থেকে বন্য কফি গাছ পাওয়া যায়, তার নাম কাফা , আরবরা তাই এই ফলের নাম দেয় কাহওয়া (Qahwa)


কফির ঔষুধি গুনাগুন সম্পর্কে পারস্য সম্রাজ্যে হাজার বছর আগে থেকেই অভিহিত ছিল। দুর্লভ এই বন্য ফলের বিচি সম্পর্কে পারস্য পলিম্যাথ আল-রাজি (৮৫৪-৯২৫) লিখেছিলেন , 


'' গরম আর শুকনা বার্ন ( Coffee Bean), পাকস্থলীর জন্য খুবই ভালো। ''


আরেক পারস্য পলিম্যাথ ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) তার বই 'কানুন ফি-আ -তীব ' “Canon of Medicine” বইতে লিখেন , 


" এই ফল ইয়েমেনে পাওয়া যায় , পরিপক্ক হলে গাছ থেকে পরে ,অপরিপক্ক বার্ন (Coffee Bean) সাদা রঙের, ওজনে ভারি আর পরিপক্ক বার্ন ( Coffee Bean) পাকা লেবুর মতো হলুদ রঙের এবং ওজনে হালকা । এই পরিপক্ক বার্ন উৎকৃষ্ট আর অসাধারণ সুগন্ধযুক্ত । এই বার্ন চামড়ার নিচের শরীরকে গরম এবং শুস্ক করে চাঙ্গা করে তুলে এবং পুরু শরীরে এক ধরণের সুগন্ধি দেয়। '' 


৯০০ সাল থেকে ইয়েমেনে নিয়মিত কফির চাষ হতো এবং কফি সুফীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল, কারণ গরম কফি রাতভর আল্লাহর জিকির করতে সুফিদের চাঙ্গা রাখতো এবং নির্ঘুম রাট কাটাতে সাহায্য করতো। ইয়েমেনি রা কফির বিন খাওয়ার পরিবর্তে এই বিন পানিতে সিদ্ধ করে খেত। এভাবেই তারা বিখ্যাত পানীয় আল-কাহওয়া (Al-Qahwah) পান করতো।  

কফি আবিষ্কারের পর প্রায় এক হাজার বছর , কফি শুধু ইসলামিক ধর্মীয় পানীয় ছিল। সুফিরা রাতভর আল্লাহর শোকর গজার , জিকির করতে কফি পান করতো, রমজান মাসে রাতের বেলা কফি পান করে জেগে থাকতো। 

আরবদের মধ্যে অনেকের বিশ্বাস , 

কফি আরবভূমিতে এসেছে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা:) জন্মের সময়। জাহেলিয়া যুগের জনপ্রিয় পানীয় ওয়াইন এর বদলে কফি এসেছে উপহার হয়ে। কফি মদ্য পানীয়ের মতো শরীরকে দুর্বল, অচেতন করে তুলে না , বরং শরীরকে চাঙ্গা আর সতেজ করে তুলে। 

ইয়েমেনিরা , সুফিরা মক্কায় হজ্জের সময় সাথে করে কফি নিয়ে যেত। সমগ্র পৃথিবীর মুসলিম তখন এই অসাধারণ সুগন্ধি পানীয়র সাথে পরিচিত হয়।  

ইজিপ্টের কায়রোতে আল আজহার ইউনিভার্সিটির ইয়েমেনি ছাত্রদের মাধ্যমে , কায়রোতে কফির প্রচলন শুরু হয় ১০ শতক থেকেই।  

ব্রিসেল তার বই , "কাহভ্যালীর কিতাব'' তে উর্ল্লেখ করেন , 

ওমর নামের এক শেইখ , ১২৫৮ সালে ভ্রমণের সময় খুদার তাড়নায় কফির ফল খেয়েছিলো। ইয়েমেনের মকা শহরে ফিরে , তার ওই ঔষুধি ফলের কথা ছড়িয়ে দেন।  

Interesting Side Note, ইয়েমেনের এই মকা শহর থেকেই মকা কফির নাম করণ করা হয়েছে।  

তুর্কিদের মধ্যে ১২ শো সালের মাঝামাঝি সময় থেকে কফি খাবার অভ্যাস শুরু হয়। ওই সময়ের কফি খাওয়ার সিরামিক এবং সীসার কাপ, জগ , পাত্র তুর্কিদের কফি খাবার অভ্যাসের জানান দেয়।  


অটোমানদের কন্সটান্টিনোপোল আক্রমণ শুরু হয় ১৪৫৩ সালের এপ্রিলে , অটোমান সৈন্যরা যুদ্ধের ময়দানের কফি নিয়ে যেত , ক্লান্ত সৈনিকদের চাঙ্গা রাখতে। 

বর্তমানে আমরা কফি ইংলিশ শব্দ COFFEE বেবহার করি এটা ডাচ শব্দ KOFFIE থেকে এসেছে , যা এসেছে তুর্কিশ KAHVE থেকে। 

আধুনিক কফি (COFFEE) আর ক্যাফে (CAFE) এই দুই শব্দই তুর্কিশ KAHVE থেকে এসেছে। অটোমান তুর্কিরা এটা এরাবিক কাহওয়া (KAHWAH) থেকে। 


ইস্তানবুল জয়ের পর , সেখানে প্রথম কফি শপ ছিল , কিভা হান ''KIVA HAN " যেটা ১৪৭৫ সালে স্থাপিত হয়েছিল। এই কফি শপকেই পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম কফি শপ হিসেবে ধরা হয়। কারণ ইয়েমেনের মকা , এইডেন এবং ইজিপ্টের কায়রোর কফি শপের নিদৃষ্ট কোনো নাম বা দলিল এখন আর পাওয়া যায় না।  


অটোমান তুর্কিদের মধ্যে কফি একটা বিশেষ গুরুত্ব ছিল। কিরকম গুরুত্ব ছিল তার একটা উদাহরণ দেই , অটোমান আইন অনুযায়ী , বিবাহিত মহিলাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং কফি দিতে অক্ষম হলে , স্বামীকে ডিভোর্স দিতে পারতো।  


কফি অটোমান খেলাফত থেকে ইতালিয়ান বন্দরনগরীতে বাণিজ্যের মাধ্যমে ইউরোপে আসে। ইতালির ভেনিসের সাথে অটোমান নিয়ন্ত্রিত উত্তর আফ্রিকা, ইজিপ্টের বাণিজ্য চলতো। ভেনিসের ব্যবসায়ীরা ১৫৭০ সাল থেকে কফি আমদানি করা শুরু করে, ১৬৪৫ সালে ভেনিসে প্রথম কফি শপ খুলে এবং ১৬৬৩ সালের মধ্যে ভেনিসে ২২৮ টি কফি শপ ছিল। প্রথমে ধনী আর সম্ভান্ত লোকজন কফি খাবার অভ্যাস শুরু করে, আস্তে আস্তে আমজনতা সবাই কফি খাওয়া শুরু করে।  


ভেনিস থেকে কফি আমালফি , তুরিন , জেনোয়া , মিলান, ফ্লোরেন্সে এবং রোমে যায় এবং এইসব শহর থেকে পরবর্তীতে পুরু ইউরোপ কফি ছড়িয়ে পরে।  

 প্রথমে মুসলিমদের কাছ থেকে ইমপোর্ট করা কফি , ইতালিতে ক্যাথলিক পাদ্রীরা এবং পোপ ভালো ভাবে গ্রহণ করেনি।  

তাদের ভাষ্যমতে,  


"মুসলিমরা খৃষ্টানদের সিম্বলিক পানীয় ওয়াইন পান করে না, আমরা কেন তাদের শয়তানের দেয়া কালো পানি , কফি পান করবো। ''

ক্যাথলিক চার্চ কফি নিষিদ্ধ করে দেয় , ১৬০০ সালে পোপ অষ্টম ক্লেমেন্ট নিজে কফি টেস্ট করে দেখেন এবং বলেন, 

"এই শয়তানের পানীয় এত মজাদার কেন? এটা দুঃখের বিষয় ইনফ্যাডেলরা (অর্থাৎ মুসলিম) এটা পান করে। ''


পোপ অষ্টম ক্লেমেন্ট তখন ক্যাথলিক পবিত্র পানিতে চুবিয়ে কফি ব্যাপ্টাইজ করে এবং কফি পান করায় নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়।  

ভিয়েনা যুদ্ধের পর অটোমান সৈন্যদের যুদ্ধের ময়দানে ফেলে যাওয়া কফির বস্তা দিয়ে ভিয়েনার প্রথম কফি শপ চালু হয়।  

ভিয়েনা যুদ্ধে অটোমান মুসলমানদের পরাজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে স্থানীয় খৃষ্টানরা , ইসলামের সিম্বল চাঁদের আকৃতির বন রুটি আর কফিতে চিনি আর ক্রিম যুক্ত করে পান করা শুরু করে। তখন থেকেই ক্রিসেন্ট রোলস আর ক্যাপপোচিনো র প্রচলন হয়।  


ইস্ট ইন্ডিয়া ট্রেডিং কোম্পানি ইয়েমেনের মকা থেকে, আর লেভেন্ট কোম্পানি সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে ইংল্যান্ডে কফি আমদানি করতো।  

১৬৫০ সালে ইংল্যান্ডে তুর্কিস ব্যবসায়ী পাসকোয়া নামে লন্ডনে প্রথম কফি হাউস "পাসকোয়া'স হেড " যাত্রা শুরু করে। ইংল্যান্ডের কফি হাউসগুলুর কমন নাম ছিল : সারচেন'স হেড , সুলতান'স হেড, টার্ক'স হেড। উর্ল্লেখ যে, আরব মুসলিম যোদ্ধাদের ইউরোপিয়ানরা সারচেন বলতো।  


এই কফি হাউসগুলোর সামনের সাইনবোর্ডে সাধারণত ইসলামিক সিম্বল ক্রিসেন্ট , তুর্কি টুপি থাকতো। ১৬০০ সালের শেষের দিকে যদি লন্ডনে কোনো ইসলামিক সাইন দেখা যেতো , তার মানে সেটা কোনো কফি হাউস।  


কফি কালটার লন্ডনে জমে উঠে, ১৭০০ শতকের শেষের দিকে লন্ডনে ৩০০০ কফি শপ ছিল। কফি শপগুলোতে ইউনিভার্সিটির ছাত্র, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, আর্টিস্ট , দার্শনিক সব সময় যাতায়াত করতো আর দিনভর বিভিন্ন চিন্তা চেতনা আর বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো কফি শপগুলুতে। এজন্য এই কফিশপ কে পেনি ইউনিভার্সিটি ও বলা হতো। কারণ, এক পেনি তে এক কাপ কফি পাওয়া যেত কফি শপ গুলুতে।  


আর্মেনিয়ার এক ব্যবসায়ী ফ্রান্সের প্যারিসে, অটোমান সম্রাজ্য থেকে কফি আমদানি শুরু করে। ১৬৬৯ সালে অটোমান এম্বাসেডর সুলাইমান শাহ , ফ্রান্সের রাজ দরবারে, কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে, এবং স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে কফির বিন বিলি করে এবং কফি খাওয়া এবং আমদানিতে উৎসাহিত করে।  


১৭ শো শতকে বাণিজ্যের মাধ্যমে কফি ইউরোপে পৌঁছে যায়। ১৬৪০ সালে কফির বিচি ডাচ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সেখানে কফি পৌঁছে। তারা যখন কফি বিক্রি করা শুরু করে , আমস্টারডামের বিভিন্ন জায়গায় কফি শপ গড়ে উঠে।

আরবরা এবং অটোমান তুর্কিরা কফি বিন অনেক সতর্কতার সাথে বেঁচাকেনা করা করতো, কফি বিন দিয়ে যাতে অন্য কেউ কফির চারা বুনতে না পারে। 

বাবা বুদান নামের এক মুসলিম পীর ১৬৭০ সালে মক্কায় হজ সম্পন্ন করে , ইয়েমেনে গিয়ে কয়েকটি কফি বিন সাথে করে নিয়ে আসে ইন্ডিয়ার মহীশুরে। মহীশুরের কর্ণাটকের চন্দ্রগিরি পাহাড়ে কফি গাছ বুনেন।    

ইন্ডিয়ান সেই সব কফি গাছ থেকে কফি বিন জাভা, ইন্দোনেশিয়াতে নিয়ে যায় ডাচ ব্যবসায়ীরা। সেখানথেকে কফি চাষ ইস্ট-ইন্ডিসের সুমাত্রা এবং সেলেব দ্বীপে ছড়িয়ে যায়। 


অন্যান্য ইউরোপীয়ানদের মতো ডাচ কলোনিও স্থানীয় ইন্দোনেশিয়ান শ্রমিকদের উপর অত্যাচার নির্যাতন করতো। ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ কোম্পানি ইন্দোনেশিয়ান কফি ফার্মের কফি ইন্দোনেশিয়ান স্থানীয় লোকজনকে খাওয়া বেআইনি ঘোষণা করে।  


সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পাকা কফি ইন্দোনেশিয়ার জঙ্গল থেকে আসা সিভেট অর্থাৎ, বন বিড়াল বা খাট্টাস খেত এবং জঙ্গলে গিয়ে মলতেগ করতো। মলের সাথে উন্নতমানের কফির বিন বের হয়ে আসতো। যেহেতু স্থানীয় ইন্দনেশিয়ানরা ডাচ কফি ফার্মের কফি পান করতে পারতো না, স্থানীয় অনেকে বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে সিভেট বা খট্টাশের শুকনা মল থেকে কফি বিন সংগ্রহ করা শুরু করে।  


পরবর্তীতে এটা বুঝা বাকি থাকলোনা যা, ফার্মের কফির থেকে জঙ্গলে খট্টাশের মল থেকে পাওয়া কফির স্বাদ আর ঘ্রান অনেক গুন্ বেশি। এই ধরণের কফিকে (KOPI LUWAK) কপি লুয়াক বলে। বর্তমানে কপি লুয়াক হলো পৃথিবীর সবচেয়ে দামি কফি বিন , এক কেজি (KOPI LUWAK) কপি লুয়াক বিন বাংলাদেশী টাকার ৫/৬ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দাম। ইউরোপ আর আমেরিকার বিত্তবানদের মধ্যে এই (KOPI LUWAK) কপি লুয়াক এর প্রচুর চাহিদা।  

ডাচ কলোনীর মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়া থেকে কফি চাষ ইউরোপে চলে আসে , তারপর কফি দক্ষিণ আমেরিকাতে ফ্রান্সের কলোনি মার্টিনীতে যায় ১৭২৩ সালে। তারপর হেইটিতে কফি চাষ শুরু হয়, যেসব কফি দিয়ে ইউরোপের কফির চাহিদা মেটানো হতো।  


যে অঞ্চলগুলার আবহাওয়া এবং মাটি কফি চাষের জন্য উপযুগি , তাকে কফি বিন বেল্ট বা সংক্ষেপে বিন বেল্ট বলা হয়। ১৭২৭ সালের মধ্যে কফি গাছ ব্রাজিলে আসে। ব্রাজিল বর্তমানে কফি চাষে পৃথিবীতে শীর্ষে। কথিত আছে যে, ব্রাজিলে ফ্রাঞ্চের গভর্নর পত্নীর প্রেমিক ছিল এক ব্রাজিলিয়ান কূটনৈতিকবিদ , যার হাতে কফি চাষের উপযুগি কফি বিন তুলে দেন গভর্নর পত্নী।  


পরবর্তীতে ব্রাজিলে কফি চাষের জন্য আফ্রিকান ক্রীতদাস ধরে আনা হয়, তাদেরকে দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করানো হতো। পরবর্তীতে ইউরোপিয়ান শ্রমিকদের যদিও ব্রাজিলে এনে পারিশ্রমিক দিয়ে কফি চাষ করানো হতো, কিন্তু ব্রাজিলিয়ান ইতিহাসের কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে ক্রীতদাস দের দিয়ে জোরকরে কফি চাষ করানোর ঘটনা। এখানে উর্ল্লেখ যে , ব্রাজিল ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ করছে অন্য সব দেশের পরে। ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলে ক্রীতদাসরা কফি চাষ করতো। ব্রাজিলের উর্বর ভূমি আর আবহাওয়া কফি চাষের জন্য উপযুক্ত এবং ব্রাজিল বিপুল পরিমান কফি চাষ করে আর এই কফি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কফি আমদানিকারী দেশ আমেরিকায় যায়।  


আমেরিকায় একসময় এমন এক ঘটনা ঘটেছিলো যা আমেরিকাতে কফি পানকারীর সংখ্যা হটাৎ করেই বাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৭৭০ সাল থেকেই ব্রিটেনের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে গিয়েছিলো। ওই সময় ব্রিটেন পুরু দুনিয়ার সিংহভাগ চায়ের বাণিজ্য এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ করতো। 


স্বাধীনতাকামী মার্কিন রাজনীতিবিদরা বোস্টনের বন্দরে ১৭৭৩ সালে আমদানি করা চা নষ্ট করে ফেলা হয়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে রাজতিনিবিদরা চায়ের পরিবর্তে কফি পানে মার্কিন জনগণকে উৎসাহিত করতো। 

অনেকের মতে , আমেরিকায় অনেকে ওই সময় চায়ের বদলে কফি পান করা দেশাত্মবোধক কাজ বলে মনে করতো। আমেরিকায় ১৮৬১ সালে সিভিল ওয়ার শুরু হলে, ইউনিয়ন সৈন্যদের মধ্যে প্রচুর কফি পান করার প্রচলন শুরু হয়। ১৮৬০ সালের পর শিল্পবিপ্লপের ফলে ক্লান্ত কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে কফি পানের অভ্যাস গড়ে উঠে। কফি একটি বিলাসবহুল পানীয় , কফি বাণিজ্য যুদ্ধের খরচ জুগিয়েছে এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯ শো শতকের পর থেকে আমেরিকা পুরু পৃথিবীর অর্ধেক কফি পান করতো।  

কফি সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায়। কফির সাথে জড়িত সবাই কফির দাম আর যোগান সম্পর্কিত সমস্যায় পড়তে থাকে । খারাপ আবহাওয়া আর কফির নানা রোগ আর কীট পতঙ্গের আবির্ভাবের ফলে কোনো কোনো বছর , চাহিদা অনুযায় কফির যোগান কম হওয়ায় কফির দাম আকাশচুম্মী হয়ে যায়।  


উচ্চ মূল্যের আশায় পরবর্তী বছর বেশি কফি চাষের ফলে মাত্রাতিরিক্ত যোগানের ফলে কফির দামে ধস পরে , সে ক্ষেত্রে কফি চাষি ক্ষতিগ্রস্থ হয় মারাত্মকভাবে।   


১৯ শো শতাব্দীর শেষের দিকে কফির যোগানে আধিক্যের জন্য কফির মূল পতন হয়। ব্রাজিল এজন্য কফির সাপ্লাই সীমিত করে দেশের ভিতরে জমা রেখে বেশি মূল্যে বিক্রি করা শুরু করে। কফির ভোক্তা দেশ কফির দাম নিয়ন্ত্রণের এই অসাধু পন্থার নিন্দা জানায়, কিন্তু কিছু কফি কোম্পানি আর ফলে অনেক লাভবান হয়।  


মার্কিন ব্যাংকের ইনভেস্ট করা টাকায় কফি শিল্প উন্নত হতে থাকে, কিন্তু ১৯২৯ সালে আমেরিকায় অর্থনৈতিক মহামন্দার ফলে , বড় ব্যাংকগুলো কফিতে বিনিয়োগ করা বন্ধ করে দেয়। যার ফলে দুইবছর কফির চাষ প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। কিন্তু কফি শিল্প থেমে থাকেনি। বিভিন্ন জাতের কফির জাতের উদ্ভাবনের ফলে কফির ফলন বেড়ে যায়। কফির প্রধান দুইটি জাত হলো এরাবিকা আর রোবোস্তা। রোবোস্তা জাতের কফির আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে ফলনে কম প্রভাব পরে আর রোগবালাই থেকে প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।  


এরাবিকার তুলনায় রোবোস্তা তেতো , স্বাদে আর গন্ধেও নিম্ন মানের। কিন্তু রোবোস্তার ফলন বেশি হয় আর তারাতারি গাছে কফি ধরে, তাছাড়া আফ্রিকায় আর ইন্দোনেশিয়াতে প্রচুর পরিমানে এই রোবস্তা কফির চাষ হয়।  

১৯৬৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল কফি এগ্রিমেন্ট এর মাধ্যমে কফির দাম নিয়ন্ত্রণের ফলে কফির চাষী আর ভোক্তা উভয়েই সুফল পেতে থাকে।  

কোটা সিস্টেমের মাধ্যমে কফি চাষ করা দেশ নির্দিষ্ট পরিমান কফি রপ্তানি করতে পারবে। যার ফলে দামে অনির্দিষ্টতা দূর হয়। কিন্তু কফি চাষ করা দেশ এই চুক্তির বাইরের দেশ গুলুতে কম দামে কফি রপ্তানি শুরু করে।  


এতে করে চুক্তির ভোক্তা দেশ ক্ষেপে যায়, কারণ তাদের বেশি দামে কফি কিনতে হচ্ছে , চুক্তি বহির্ভুত দেশের তুলনায়।  

বস্তুত পক্ষে এমন কোনো সিস্টেম বের করা অসম্ভব যেখানে সব দেশ খুশি থাকবে।  

 কফির প্রধান আকর্ষণই হলো তিক্ততা, টক , ঘ্রান ইত্যাদি। ক্যাফিন ছাড়াও কিভাবে কফির বিন বের করা হয়, শুকানো হয়, রোস্ট করা হয় , কফির বিন কতদিন আগে বের করা হয়েছে এসবের উপর হাজার ধরণের আর স্বাদের কফি পাওয়া যায়।  


আগে কফির গুঁড়া গরম পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়া হতো, আস্তে আস্তে কফি ছেকে আর অনেক জটিল পদ্ধতিতে কফি পান করার প্রচলন হয়।  

১৯ শো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপ কফি আস্তে আস্তে ছেঁকে পান করার প্রথা জনপ্রিয় হয়।  


ভূমধ্যসাগরের আসে পাশের অঞ্চলের মানুষজন কড়া স্বাদের কফি পান করতে পছন্দ করে বেশি। ১৯০১ সালে ইতালিতে এসপ্রেসো মেশিন উদ্ভাবিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বড় কোম্পানির সুবাদে ইনস্ট্যান্ট কফির প্রচলন শুরু হয়, যদিও স্বাদে একটু নিম্নমানের , তবুও সহজে, তাড়াতাড়ি কফি বানানোর সুবিধার জন্য পৃথিবী জুড়ে ইনস্ট্যান্ট কফির প্রচলন জনপ্রিয় হয়।  

ইনস্ট্যান্ট কফি আর এসপ্রেসোর জন্য রোবোস্তা কফি বেবহার করা হয়। যখন ইনস্ট্যান্ট কফির জনপ্রিয়তা পৃথিবীব্যাপী তুঙ্গে, ১৯৮০ সাল থেকে উন্নতমানের কফির বিনের চাহিদা বাড়তে থাকে। 

কলম্বিয়া , কোস্টারিকা এবং গুয়াতেমালার অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে এরাবিকা কফি চাষ করে, বিন বের করে, রোস্ট করে অনেক উচ্চ দামে বিক্রি করা হয়, এগুলুকে স্পেশাল্টি বা হাই কোয়ালিটি কফি বলে। পৃথিবীব্যাপী ব্র্যান্ডেড কফি চেইনের ফলে স্পেশাল্টি কফি সর্বজনীন জনপ্রিয় হয়েছে। ১৯৭১সালে সিয়াটলে একটি ছোট কফি শপ থেকে ষ্টারবাকস কফির সূচনা হয়। 

বর্তমানে দুনিয়াব্যাপী প্রতিদিন ২ বিলিয়ন কাপ কফি পান করা হয় আর কফি হলো জ্বালানি তেলের পর সবচেয়ে আমদানি করা পণ্য। প্রতি বছর পৃথিবীবেপী কফির বাণিজ্য প্রায় ১০০ বিলিয়ন ইউ.এস. ডলার মূল্যের। 


মুসলমানদের কফি আবিষ্কারের উপর বাংলা ডকুমেন্টারী: 


© মোহাম্মদ জুলফিকার রিজন 2021 (Copy without Credit Not Allowed)


Bibliography:

Abd-al-Qadir ibn Muhammed al-Ansari al-Jaziri al-Hanbali (circa 1558), 

'Umdat al-Safwa fi hill al-qahwa', 1826 ed. De Sacy, A.I.S., Chrestomathie arabe, 2nd edition, 3 volumes, Paris.

Arnold, N and Patel, V(1993) 'Coffee is one of our favourite drinks. Find out where it is grown and how it first came to thios country', The Guradian Education, September 7, 1993.

Birsel, Salâh. (1975), 'Kahveler kitab'. Koza Yaynlar, bask- Istanbul.

Burn, J.H. (1855), 'A descriptive catalogue of the London traders, tavern, and coffee-house token', 2nd ed. Arthur Taylor, London, pp. 109-110.

Chew Samual C. (1974) 'The crescent ad the rose', Oxford University Press, New York.

Darby, M.(1983) The Islamic Perspective, An aspect of British Architecture and Design in the 19th 

century', Leighton House Gallery, London.

Ellis Aytoun (1956), 'The penny universities: a history of the coffee houses', Secker & Warburg, London.

Ellis, John (1774) 'An Historical Account of Coffee with an Engraving, and Botanical Description of the Tree : To Which Are Added Sundry Papers Related to Its Culture and Use, as an Article of Diet and of Commerce'. Printed for Edward and Charles Dilly, London.

Galland Antoine (1699), 'de l'origine et du progrez du café', Éd. originale J. Cavelier, - La Bibliothèque, coll. L'Écrivain Voyageur, Paris, 1992.

Hattox, R.S. (1988) 'Coffee and Coffeehouses; the origins of a social beverage in the Medieval Near 

East, University of Washington Press, Seattle and London.

Ibn al-'Imad, 'Abd al-Hayy ibn Ahmad, (1623-1679). 'Shadharat al-dhahab fi akhbar man dhahab / lilmu'arrikh Abi al-Fallah', Maktabat al-Qudse, al-Qahirah, 1931, vol. 8, p.40. cited by Hattox (1988).

Sweetman, J. (1987), 'The oriental obsession : Islamic inspiration in British and American art', Cambridge University Press, Cambridge. (Cambridge studies in the history of art).

Ukers, William H. (1935), 'All About Coffee', 2nd Edition; The Tea & Coffee Trade Journal Company,.New York.

#জ্ঞানবিজ্ঞানেমুসলিমদেরঅবদান #মুসলিমস্থাপত্য #কফির_ইতিহাস #HistoryofCoffee #Coffee #alkahwah


কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.