✪ভূমিকা
ঔপনিবেশিক ভারত বা কলোনিয়ান ভারত (Colonial India) বলতে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের দ্বারা ভারতীয় উপমহাদেশ ও ভারতীয় মহারাজা দের উপর ব্যবসার মাধ্যমে ক্ষমতা বিস্তারনের প্রভাব কে বোঝায়। খ্রিষ্টপূর্ব তিনশ শতকে গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডারের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ইউরোপীয় অধিবাসীদের পা পড়ে ভারত বর্ষে। পরবর্তীতে ১৫১০ সালে পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা দেয়ারা গোয়ায় স্থাপিত হয়।বাংলায় ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল অব্দি যে শাসন চলে তাই ঔপনিবেশিক শাসন।
প্রাচীনকাল থেকেই কোন কোন দেশের উদ্বৃত্ত বা উদযোগী মানুষ অন্য দেশে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে এবং কালক্রমে সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়েছে, সেখানে রাজ্য স্থাপন করেছে, এই বসতি কেই কলোনি বলা হয় বা উপনিবেশ বলা হয়।
ফরাসি বাণিজ্য কুঠি পন্ডিচেরির গভর্নর ডুপ্লের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপ ভারতের বাংলা সুবাহ (বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা) ও দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক ও হায়দ্রাবাদে উপনিবেশ গড়ে তুলে। ১৬৯৮ সালে কোম্পানি কলকাতা সোটানটি ও গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রামের জমিদার স্বত্ব কিনে নেয়। ১৭০০ সালে কোম্পানি যে দূর্গটি নিমার্ণ করে তা ইংল্যান্ড রাজ তৃতীয় উইলিয়ামের নামে পরিচিত হয়। মাদ্রাজ ও কোম্পানির একটি প্রধান ঘাঁটি ও বাণিজ্যিক বন্দরে পরিণত হয়। মোগল সম্রাট ফারুকশিয়ারের রাজত্বকালে মুর্শিদ কুলি খাঁ ১৭১৭ সালে বাংলার সুবাহর সুবহা দার নিযুক্ত হন।
তিনি মুঘল সম্রাট কে নিয়মিত কর দিলেও কার্যত স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতেন। তিনি বাংলার অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ইউরোপীয় বণিকদের বাংলায় ব্যবসা বাণিজ্য করতে উৎসাহ দিলেও তাদের অন্যায় দাবি দাওয়া মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। হ্যামিলটন নামে একজন ইংরেজ চিকিৎসক সম্রাটকে এক কঠিন রোগ থেকে মুক্ত করাই সম্রাট ঘোষণা করেন তার কোন সুবাদার ইংরেজদের প্রতি দুর্ব্যবহার করতে পারবেন না। বার্ষিক ৩০০০ টাকা মুঘল রাজকোষে জমা দিয়ে ইংরেজ কোম্পানি বাংলায় এবং ১০০০০ টাকা দিয়ে সুরাট বন্দরে বিনা সুল্কে ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারবে। কলকাতার কাছাকাছি কয়েকটি গ্রাম্য কিনে নিতে পারবে। টাকশালে প্রস্তুত কোম্পানির মুদ্রা সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্য চালু করা যাবে। মুর্শিদাবাদের টাকশালে ধাতু দিয়ে ইংরেজ কোম্পানি মুদ্রাও তৈরি করতে পারবে। কলকাতার ইংরেজ প্রধানের কোন ছাড়পত্রে কোম্পানির মাল বলে লেখা থাকলে তার জন্য বাংলার কোন শুল্ক দিতে হবে না এবং নবাবের কর্মচারীরা সে মালে সন্দেহও করতে পারবে না। ফারুকশিয়ারের কাছ থেকে ১৭১৭ সালে ইংরেজরা এই ফরমান আদায় করে।
ইউরোপিয়রা প্রথমে ভারত বর্ষে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসে কিন্তু তারা ধীরে নবাবের নিকটস্থ লোকজন কে কব্জা করে নেয়।এবং নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে নবাবের নিকটস্থ মীরজাফরের বিশ্বাস ঘাতকতায় নবাবের পরাজয়ের ফলে ভারত উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত নবাবকে আটক ও নির্মমভাবে হত্যার পর ইংরেজরা মীরজাফরকে নবাব বানালেও মূল ক্ষমতা চলে যায় ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের হাতে। পরে ১৭৬৫ সালে ইংরেজরা দিল্লির সম্রাটের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা-বিহার-ওড়িশার রাজত্ব লাভ করে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তারা নবাবকে ক্ষমতাহীন দায়িত্ব প্রদান করে সিংহাসনে বসিয়ে রাখে, অন্যদিকে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব হাতে রাখে ইংরেজরা। ইংরেজরা প্রজাদের অতিরিক্ত কর দেওয়ার জন্য বল প্রয়োগ করতে থাকে। অতিরিক্ত করের চাপ আর অনাবৃষ্টির ফলে ১১৭৬ সনে বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তবে পাশাপাশি ইংরেজদের অল্প কিছু ভালো উদ্যোগও ছিল। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন ও পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের কাজও তারা করেছে। এসব কারণে বলা যায়, পলাশীর যুদ্ধের ফলে বাংলায় ঔপনিবেশিক শাসনের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
★ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পটভূমি
⃣ বাংলায় ইংরেজ প্রভুত্ব স্থাপন
মুর্শিদ কুলি খান ও বাংলার নবাবগণঃ সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে মুর্শিদ কুলি খান বাংলার দেওয়ান হন। ১৭০৩-১৭০৪ সালে তিনি দেওয়ানী দফতর ঢাকা হইতে মকসুদাবাদে স্থানান্তর করেন। তাঁহার নামানুসারে ইহার নাম হয় 'মুর্শিদাবাদ'। পরে তিনি বাংলার সুবাদার হন এবং স্বাধীন নবাবী চালু করেন। ১৭২৫ সালে মুর্শিদ কুলি খানের মৃত্যু হইলে বাদশাহী ফরমানের বলে তাঁহার জামাতা সুজাউদ্দিন বাংলার নবাব হন। সুজাউদ্দিন ন্যায়পরায়ণতার জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ১৭৩৯ সালে তাঁহার মৃত্যু হইলে তাঁহার পুত্র সরফরাজ খান নবাব হন। কিন্তু পিতার ন্যায় তাঁহার যোগ্যতা ছিল না। কয়েক মাসের মধ্যেই বিহারের শাসনকর্তা আলীবর্দী খান তাঁহাকে পরাজিত ও নিহত করিয়া বাংলা অধিকার করেন, এবং সম্রাট মুহাম্মদ শাহকে প্রচুর উপঢৌকন দিয়া তাঁহার নিকট হইতে এক ফরমান আদায় করিয়া লন। আলীবর্দী খান একজন কর্মঠ ও যোগ্য লোক ছিলেন এবং এইভাবেই তিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় স্বাধীন রাজত্ব চালাইতে থাকেন। তিনি একজন চালাক, বিচক্ষণ ও নির্ভীক যোদ্ধা ছিলেন। খুব অল্প গুণই আছে, যেগুলি তাঁহার নিকট ছিল না। ” ১ ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের প্রতি তাঁহার মনোভাব কঠোর কিন্তু পক্ষপাতহীন ছিল এবং শুধু বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সময় সময় তাহাদের নিকট হইতে কর আদায় করেন। কিন্তু তাঁহার ভাগ্যে কোন সন্তান ছিল না।
তাঁহার রাজত্বের অধিকাংশ সময় প্রতি বৎসর মারাঠা বর্গীর হামলা বাংলাদেশে একটি স্থায়ী উদ্বেগ সৃষ্টি করে এবং বিহারের দ্বারভাঙ্গার আফগানদের সঙ্গে মিলিত হইয়া তাঁহার আফগান সেনাপতিগণ তাঁহার আধিপত্যের উপর ভীষণ হুমকির সৃষ্টি করে। যদিও আলীবর্দী খান ভাস্কর পণ্ডিত নামে একজন মারাঠা সেনাপতিকে হত্যা করিতে সমর্থ হন, কিন্তু তবুও বহু যুদ্ধ-বিগ্রহের পর মারাঠাদের হাতে উড়িষ্যার একাংশ ছাড়িয়া দিয়া এবং বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা চৌথ দিবার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া তিনি মারাঠাদের সহিত সন্ধি করেন (১৭৫১)। বাংলাদেশ অতঃপর মারাঠা বর্গীর অত্যাচার হইতে রক্ষা পায় নবাব আলীবর্দী খান ১৭৫৬ সালে মৃত্যুমুখে পতিত হন।
সিরাজ উদ্দৌলাহঃ আলীবর্দী খানের কোন পুত্র সন্তান ছিল না তাঁহার তিনটি কন্যাকে তিনটি ভ্রাতুষ্পুত্রের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়। তাঁহার সর্বকনিষ্ঠ কন্যার পুত্র সিরাজ উদ্দৌলাহ তাঁহার মনোনীত উত্তরাধিকারী। কিন্তু এই বন্দোবস্ত স্বভাবতই তাঁহার অন্য দুই জামাতার মনঃপুত হইল না। অন্য দুই জামাতার একজন ঢাকার গভর্নর এবং অপরজন পূর্ণিয়ার গভর্নর আলীবর্দী খানের রাজত্বের শেষের দিকে এই দুই জামাতার মৃত্যু হওয়ায় এই সমস্যার সমাধান হইয়া যায়। কিন্তু আলীবর্দী খানের বিধবা পত্নী ঘসেটি বেগম ও তাঁহার পুত্র শওকত জঙ্গ এবং দেওয়ান রাজবল্লভ সিরাজের জন্য বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করেন। যাহা হউক, ১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর আপাতত নির্বিঘ্নেই সিরাজ উদ্দৌলাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন।(১)
⃣ পলাশির যুদ্ধ
১৭৫৬ সালে নবাব আলীবর্দি মারা যান। এরপর তাঁর পৌত্র সিরাজ - উদ দৌলা বাংলার সিংহাসন আরোহন করেন। সিংহাসন আরোহনের কিছুদিনের মধ্যেই ইংরেজদের সাথে তাঁর বিরোধ বাঁধে, যার চূড়ান্ত পরিনতি হল ১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পটভূমি বিশ্লেষণ করলেই সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধের কারণগুলি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে এটাও বোঝা যাবে এই বিরোধে সিরাজেরে ‘অহমিকাবোধ’ ও ‘অর্থলোভ’ দায়ী ছিল কিনা।
⃣ যুদ্ধের পটভূমি
সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধের কারণগুলি হল -
1) আনুগত্যদানে বিলম্ব। সিরাজ বাংলার সিংহাসনে বসলে প্রথা অনুযায়ী নবাবের প্রতি আনুগত্য জানিয়ে ফরাসি, ওলন্দাজ প্রভৃতি কোম্পানিগুলি উপঢৌকন পাঠালেও ইংরেজরা ইচ্ছা করে উপঢৌকন পাঠাতে দেরি করে। এতে সিরাজ অপমানিত হন।
2) ষড়যন্ত্রের সংবাদ। সিংহাসনে বসার সময় থেকে ঘষেটি বেগম, সৌকত জঙ্গ ও কয়েকজন রাজকর্মচারি সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র লিপ্ত ছিলেন খবর আসে যে, এই ষড়যন্ত্রে ইংরেজরা যুক্ত আছে এবং তাঁকে সরিয়ে অনুগত কাউকে সিংহাসনে বসানোর চক্রান্ত করছে।
3) কৃষ্ণদাসকে আশ্রয়দান। ঘষেটি বেগমের প্রিয়পাত্র ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভ আর্থিক তছরুপের দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন। সিরাজ রাজস্বের সঠিক হিসাব নিয়ে মুর্শিদাবাদে হাজির হতে বলেন। রাজবল্লভ নবাবের নির্দেশ অমান্য করে প্রচুর ধনরত্নসহ পুত্র কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেন। নবাব ইংরেজদের কৃষ্ণদাসকে ফেরৎ পাঠানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু ইংরেজরা এই নির্দেশ অমান্য করে। এই ঘটনায় সিরাজ প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হন।
4) দূর্গনির্মান। দাক্ষিণাত্য যুদ্ধের অজুহাতে ইংরেজ ও ফরাসিরা বাংলায় দূর্গ নির্মান শুরু করে। সিরাজের নির্দেশে ফরাসিরা দূর্গনির্মান বন্ধ করলেও ইংরেজরা নবাবের নির্দেশ বারংবার অমান্য করে। এই ঘটনায় নবাব অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন ও দূর্গনির্মাণে সামরিক হস্তক্ষেপ করেন।
5) দস্তকের অপব্যবহার। ইংরেজরা ১৭১৭ সালে মোঘল সম্রাট ফারুকশিয়ারের কাছ থেকে দস্তক লাভ করে এর ফলে তারা বাংলায় কয়েকটি পন্যের বিনাশুল্কে বানিজ্য করার অধিকার পায়। কিন্তু কোম্পানি ও কোম্পানির কর্মচারিরা এর অপব্যবহার শুরু করলে নবাবের ব্যপক রাজস্বের ক্ষতি হয়। সিরাজ এর প্রতিবাদ করলে বিরোধ চরমে ওঠে।
6) নারায়ণ দাসকে অপমান। দূর্গনির্মান, দস্তকের অপব্যবহার, কৃষ্ণদাসকে আশ্রয়দান প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করার জন্য সিরাজ নারায়ণ দাসকে দূত হিসাবে কলকাতায় পাঠান। ইংরেজরা নারায়ণ দাসকে গুপ্তচর বলে অপমান করে এবং তাড়িয়ে দেয়।
7) নবাবের কলকাতা অভিযান। এইভাবে একের পর এক ঘটনায় নবাব উপলব্ধি করেন, ইংরেজরারা তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতাকেই চ্যালেঞ্জ করছে । তাই তাদের শিক্ষা দিতেই নবাব প্রথমে কাশিমবাজার কুঠি (৪ঠা জুন ১৭৫৬) এবং পরে কলকাতা ( ২০ জুন ১৭৫৬) দখল করেন। ইংরেজরা অভিযোগ করে, এই সময় নবাব ‘অন্ধকূপ হত্যা’ সংঘটিত করেন, যার ফলে ১২৩ জন ইংরেজ বন্দি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়।
৪) আলিনগরের সন্ধি। ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাস। কলকাতার শাসনকর্তা মানিকচাঁদকে উৎকোচ দিয়ে ইংরেজরা কলকাতা পুনর্দখল করে। দরবারের অনেকের ষড়যন্ত্রের কারণে সিরাজের এবারের কলকাতা অভিযান ব্যর্থ হয়। ফলে তিনি আলিনগরের সন্ধি করতে বাধ্য হন।
⃣ পলাশীর যুদ্ধ ও নবাবের মূল্যায়ন
এইভাবে মুর্শিদাবাদের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি, যেমন – রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, উমিচাদ ইয়ারলতিফ, মিরজাফর প্রমুখের ষড়যন্ত্রে এবং ইংরেজদের ক্ষমতার মোহে এই ষড়যন্ত্রে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ায় পলাশীর যুদ্ধের পটভুমি তৈরি হয়। আর এই পটভূমিতেই লর্ড ক্লাইভ আলিনগরের সন্ধি ভঙ্গের অজুহাতে মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে। শুরু হয় পলাশির যুদ্ধ ২৩ জুন ১৭৫৭)। যুদ্ধে পরাজয়রের ফলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য প্রায় ২০০ বছরের জন্য অস্তমিত হয়। সুতরাং, ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের বিরোধের জন্য ইংরেজরাই মূলতঃ দায়ী। আধুনিক গবেষণায় প্রমাণিত, ১৮ ফুট লম্বা ও ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি চওড়া একটা ঘরে এতজনকে আটকে রাখা যায় না এপ্রসঙ্গে অ্যানি বেসান্ত বলেছেন, ‘জ্যামিতি প্রমাণ করছে পাটিগণিতের অঙ্কটি ভুল '। ইতিহাসবিদ ব্রিজেন গুপ্ত যুক্তি সহকারে ঐতিহাসিক হিলের মত খণ্ডন করে বলেছেন, নবাবের ‘অহমিকাবোধ' এবং 'অর্থলোভ নয়’, ঐশ্বর্য ও ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার মোহে মত্ত ইংরেজরাই পলাশির যুদ্ধের জন্য দায়ী।
⃣ যুদ্ধের ফলাফল
এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারি। ঐতিহাসিক ম্যালেসন বলেছেন, পলাশির যুদ্ধের মত আর কোনো যুদ্ধের ফলাফল এত প্রত্যক্ষ, এত ব্যপক ও এত স্থায়ী হয় নি। এর ফলাফল বা গুরুত্ব হল –
1) কিং মেকার। এই যুদ্ধের ফলে ইংরেজ কোম্পানি কার্যত বাংলার নবাবি শাসনের পরোক্ষ পরিচালকে (King Maker) পরিণত হয়।
2 ) পলাশির লুণ্ঠন। মিরজাফরকে সিংহাসনে বসিয়ে উপঢৌকন বাবদ কোম্পানির কর্মচারিরা প্রভূত অর্থ উপার্জন করে, যা ‘পলাশির লুণ্ঠন ' নামে পরিচিত ।
3) অন্য অঞ্চলে আধিপত্য। পলাশির সাফল্যকে সামনে রেখে ইংরেজ কোম্পানি ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে আধিপত্য প্রসারের স্বপ্ন দেখতে থাকে।
4) ফরাসিদের বিতাড়ন। ইংরেজরা এই যুদ্ধে জয় লাভের ফলে বাংলা থেকে ফরাসিরা বিতাড়িত হয়। বাংলার অর্থ কাজে লাগিয়ে দাক্ষিণাত্যে ফরাসিদের বিরুদ্ধে জয়ী হয়।
5) শূন্যতা ও জটিলতা। এই যুদ্ধে নবাবের পরাজয়ের ফলে বাংলার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এক ভয়াবহ শূন্যতা ও জটিলতা সৃষ্টি হয়।
6) বাণিজ্যে একচেটিয়া প্রাধান্য । এই যুদ্ধে জিতে ইংরেজ কোম্পানি বাংলায় দস্তক বা বিনাশুল্কে বাণিজ্যিক অধিকারের সফল প্রয়োগ ঘটায়। ফলে বাংলার ব্যাবসা - বাণিজ্যে কোম্পানির একচেটিয়া প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
7) দেশীয় বাণিজ্য ধ্বংশ। কোম্পানির একচেটিয়া প্রাধান্যের ফলে দেশীয় ব্যাবসা - বাণিজ্য ক্রমে ধ্বংসের পথে এগোয়।
৪) নবজাগরণের সূচনা। পলাশি যুদ্ধের পর ইংরেজরা এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারার প্রসার ঘটাতে শুরু করে। 'আইনের শাসনে'র ধারণার প্রবর্তন করে। ফলে ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতায় নবজাগরণ ঘটে। ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার বলেছেন, 'On 23rd June, 1757, the middle ages of India ended and her modern age began’.
★বক্সারের যুদ্ধ
বক্সার যুদ্ধের পটভূমি ও কারণ মীর কাশিম বাংলার সিংহাসনে বসেই বুঝতে পেরেছিলেন ভবিষ্যতে ইংরেজদের সাথে তাঁর সংঘর্ষ অনিবার্য। ইংরেজদের সাথে সরাসরি দ্বন্দ্বে না জড়ালেও তাদের প্রভুর আসনে রাখতে চাওয়ার মনোবৃত্তি ছিল না তাঁর। যেভাবেই হোক ক্ষমতায় গিয়ে তিনি প্রকৃত নবাব হিসেবে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা শাসন করতে চেয়েছিলেন। ফলে তিনি দেশ, জাতি এবং নিজের প্রয়োজনে কিছু পদক্ষেপ নিয়ে ইংরেজদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন মূলত বক্সারের যুদ্ধের নেপথ্য কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
১. রাজধানী স্থানান্তরঃ
মীর কাশিম উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে এদেশে ইংরেজদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। এ কাজে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে তারাই এদেশের ভাগ্যবিধাতা হয়ে উঠবে। তাই তিনি রাজধানীতে ইংরেজ রেসিডেন্টের শাসনকার্যে অবৈধ হস্তক্ষেপ বন্ধ করার উদ্যোগ নেন। তিনি প্রশাসনকে ইংরেজ প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে রাজধানী স্থানান্তর করেন। এক্ষেত্রে নতুন স্থাপিত রাজধানীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তিনি এর চারপাশে নানা ধরণের পরিখা খনন করেছিলেন। পাশাপাশি এখানে শক্তিশালী দুর্গও নির্মাণ করা হয়েছিল। তিনি ধারণা করেছিলেন ইংরেজরা পুনরায় মীরজাফরকে বাংলার সিংহাসনে বসাতে পারে। তাই ইংরেজদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধের জন্যও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। এজন্য তিনি সামরু ও মার্কার নামে দু'জন ইউরোপীয় সৈনিকের সাহায্যে বাংলার সেনাবাহিনীকে ইউরোপীয় সামরিক পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপারে তিনি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ হতে স্বাধীন থাকার চেষ্টা করেন। এজন্য মুঙ্গেরে তিনি কামান, বন্দুক ও গোলাবারুদ নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। বিহারের শাসনকর্তা রামনারায়ণের ইংরেজ প্রীতি ও দুর্নীতি লক্ষ্য করে তাকে পদচ্যুত করা হয়। তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হলে মীরকাশিমের উপর ক্ষিপ্ত হয় ইংরেজরা। এই অসন্তোষ একটা পর্যায়ে গিয়ে যুদ্ধের রূপ নিয়েছিল।
২. ফরমান অবমাননা :
মুঘল সম্রাট ফররুখ শিয়ারের কাছ থেকে ১৭১৭ সালে প্রাপ্ত একটি ফরমান বলে ইংরেজ কোম্পানি বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে। দস্তক নামে পরিচিত ছাড়পত্র দ্বারা কোম্পানির মালামাল চিহ্নিত করার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু কোম্পানির অনেক কর্মকর্তা এই দস্তকের অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত মালামালকেও কোম্পানির হিসেবে দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করেছে। ফলে দেশীয় বণিকগণ ব্যবসা ক্ষেত্রে ক্ষতির সম্মুখীন হন। অনদিকে এবং নবাব নিজেও প্রাপ্য বাণিজ্য শুল্ক হতে বঞ্চিত হতে থাকেন। যা একটা পর্যায়ে ভয়াবহ সংঘাতের কারণ হয়ে দেখা দেয়।
৩. অবাধ বাণিজ্যের প্রচলন :
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এমনিতেই অনেক সুবিধা ভোগ করত। তার উপর কোম্পানির কর্মকর্তা - কর্মচারিদের অবৈধ আন্ত: বাণিজ্য দেশীয় বণিকদের কোণঠাসা করে ফেলে। দস্তক নামে পরিচিত ছাড়পত্র দ্বারা কোম্পানির মালামাল চিহ্নিত করার ব্যবস্থা ছিল। এই দস্তকে সাক্ষর করতেন কোম্পানির কর্মকর্তারা। কিন্তু কোম্পানির অনেক কর্মকর্তা এই দস্তকের অপব্যবহার করে নিজেদের ব্যক্তিগত মালামালকেও কোম্পানির বলে বহন করেছেন। পক্ষান্তরে ইংরেজ বণিকদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছিল না তারা। মীর কাশিম এ বিষয়ে গভর্নরের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। বাধ্য হয়ে তিনি এক পর্যায়ে ইংরেজ ও দেশীয় ব্যবসায়ী নির্বিশেষে সকল ব্যবসায়ীদের উপর থেকে বাণিজ্য শুল্ক উঠিয়ে দিয়েছিলেন। এতে নবাবের রাজস্ব আয় কমে গেলেও দেশীয় বণিকদের সাথে বিদেশী বণিকদের অন্যায় প্রতিযোগিতার পথ বন্ধ হয়ে যায়। এ নতুন ব্যবস্থার ফলে ইংরেজদের স্বার্থে আঘাত লাগে। তারা চেষ্টা করে নবাবকে শায়েস্তা করার জন্য। বক্সারের যুদ্ধের ঘটনাবলী নবাব মীর কাশিমের গৃহীত নানা সিদ্ধান্ত ইংরেজদের ক্ষোভের কারণ হয়। তারা নবাবকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর ফলে বক্সারের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধের শুরুতেই কলকাতায় ইংরেজ কুঠির প্রধান এলিসের সঙ্গে নবাবের সংঘর্ষ বাধে। ইংরেজ নেতা এলিস হঠাৎ পাটনা আক্রমণ করে শহরটি দখল করে নিলে বাধ্য হয়ে নবাবকে তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে হয়েছিল। মীর কাশিম পাটনা হতে এলিসকে তাড়িয়ে দিয়ে পুরো এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করেছিলেন। তারপর কোলকাতা কাউন্সিল নবাবের বিরুদ্ধে ১৭৬৩ সালে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মীর কাশিম মেজর অ্যাডামসের নেতৃত্বে ইংরেজরা নবাবের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সেনাবাহিনী প্রেরণ করে। সৈন্য সংখ্যা বেশি থাকা সত্ত্বেও গিরিয়া, কাটোয়া ও উদয়নালার যুদ্ধে (১৭৬৩ খ্রিঃ) শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন মীর কাশিম । এরপর বাধ্য হয়ে তিনি অযোধ্যায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। মীর কাশিমের বিরুদ্ধে ১৭৬৩ সালে যুদ্ধ চলাকালীন ইংরেজগণ আবার মীরজাফরকে নবাব হিসেবে বাংলার সিংহাসনে বসিয়েছিল। নতুনভাবে নবাব হয়ে বিশ্বাস ঘাতক মীরজাফর মীর কাশিম কর্তৃক জারীকৃত ইংরেজ স্বার্থবিরোধী প্রত্যেকটি ঘোষণা ও বিধি প্রত্যাহার করে নেয়। বার বার পরাজিত হয়েও মীর কাশিম হাল ছাড়েননি। তিনি এরপর অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও মুঘল সম্রাট শাহ আলমের সহায়তা প্রার্থনা করেন। তাদের সহযোগিতায় গঠিত সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে ১৭৬৪ সালে মীর কাশিম ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। তবে বরাবরের মত এবারেও ভাগ্য সহায় হয়নি তার। তিনি বিহারের বক্সার নামক স্থানে সংঘটিত যুদ্ধে মেজর মনরোর সেনাদলের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। বলতে গেলে এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলায় স্বাধীনতা ধরে রাখার শেষ সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায়। এরপর ইতিহাসের পাতায় মীর কাশিমের নাম সেভাবে পাওয়া যায়নি। অনেকের মতে তিনি আত্মগোপনে চলে গেছেন। কারও কারও বিশ্বাস নবাব সিরাজ উদ্দৌলার মত তাকেও হত্যা করা হয়েছিল। ফলাফল ও গুরুত্ব বক্সারের যুদ্ধ বাংলার পাশাপাশি পুরো ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল। তাই এর ফল যুগান্তকারী এবং সুদূরপ্রসারী। অনেক দিক থেকে এ যুদ্ধ পলাশীর যুদ্ধ অপেক্ষা অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। নিচে এর গুরুত্বগুলো সংক্ষেপে বর্ণনা কর হলো
১ . এ যুদ্ধে পরাজিত দিল্লির মুঘল সম্রাট শাহ আলম ইংরেজদের পক্ষে যোগদান করে। মূলত সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে ইংরেজদের একটা চুক্তি হয়েছিল। এই চুক্তির বলে কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দিউয়ানি লাভ করে।
২. অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা রোহিলাখণ্ডে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
৩ . যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মীর কাশিম গা ঢাকা দিয়েছিলেন। অবশেষে ১৭৭৭ সালের দিকে দিল্লির কাছে তার মৃত্যু হয়। অনেকের ধারণা বাংলার এই শেষ স্বাধীনতাকামী নবাবকে হত্যা করা হয়েছিল। সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে ইংরেজদের একটি চুক্তি হয়েছিল যে চুক্তির বলে কোম্পানি বাংলা বিহার, উড়িষ্যার দিউয়ানি লাভ করে।
৪. এ যুদ্ধের ফলে মীরকাশিমের ইংরেজ বিতাড়ণ ও স্বাধীনতা রক্ষার শেষ স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়। বলতে গেলে উপমহাদেশে ইংরেজ প্রভাব - প্রতিপত্তি বহুগুণে বেড়ে যায়।
⃣ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানী লাভ
১৭১৭ সালে সুবেদারের দায়িত্ব প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত মুর্শিদ কুলি খান বাংলার দিউয়ান ছিলেন। তবে মুঘল সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলা শাসনকারী এই নবাব এবং তাঁর উত্তরসূরীরা একইসঙ্গে সুবাদার ও দিউয়ানের দায়িত্ব পালন করতেন। শুধু তাই নয়, মারাঠা উৎপাতের কারণে আলীবর্দী খান কেন্দ্রকে রাজস্ব পাঠানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরে সিরাজউদ্দৌলা ও মীরজাফরের আমলে কেন্দ্রকে রাজস্ব দেয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধের পর কোম্পানি হয়ে ওঠে পুরো দেশের হর্তাকর্তা। তারপর কেন্দ্রিয় রাজনীতি তথা সমগ্র উপমহাদেশের রাজনীতি বদলে যায়। তখন সবকিছু এমনভাবে পরিবর্তিত হয় যা থেকে উত্তোরণের পথ ছিল না। ফলে সুবে বাংলা আবার আগের মতো দিল্লিতে রাজস্ব পাঠানো বন্ধ করে দেয়। বলতে গেলে সম্রাট শাহ আলম বাংলা থেকে রাজস্ব প্রাপ্তির আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। এমনি পরিস্থিতিতে সম্রাট কয়েকবার কোম্পানিকে বাৎসরিক কিছু উপঢৌকনের বদলে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দিউয়ানি গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তখন তার সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিল কোম্পানি। পরে বক্সার যুদ্ধের পর কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা চরমে ওঠে। তাদের হঠকারিতায় বাংলার রাজনৈতিক পরিবেশ খারাপ হয়। ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ কোম্পানির দুর্নীতি দমন ও স্বার্থ বৃদ্ধির জন্য ক্লাইভকে লর্ড উপাধি দিয়ে দ্বিতীয় বারের মত বাংলায় প্রেরণ করে (১৭৬৫-১৭৬৭ খ্রি)। বাংলায় এসে ক্লাইভ মীর কাশিমের মিত্রশক্তি অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের প্রতি নজর দেন। বক্সার যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ তাদের নিকট থেকে ৫০ লক্ষ টাকা এবং কারা ও এলাহাবাদ জেলা দু'টির দখল নেয়া হয়। এরপর তিনি অযোধ্যার নবাবের সাথে মিত্রতা স্থাপনের পাশাপাশি দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সাথেও সন্ধি স্থাপন করেছিলেন। বছরে ২৬ লক্ষ টাকা কর প্রদানের বিনিময়ে সম্রাটের কাছ থেকে কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দিউয়ানির দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরপর ১৭৬৫ সালে ১২ আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিউয়ানির সনদ অর্জন করেছিল।
⃣ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দিউয়ানি লাভের ফলাফল ও গুরুত্ব:-
বাংলার প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দিউয়ানি লাভ ছিল গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এর ফলে নতুন গতিপথ লাভ করে বাংলার ইতিহাস। এক্ষেত্রে যে পরিবর্তনগুলো দৃশ্যমান হয়েছিল তা হচ্ছে —
১)রাজনৈতিক বিজয় :
বাংলায় কোম্পানির দিউয়ানি লাভ ছিল কোম্পানির জন্য একটি বিরাট রাজনৈতিক বিজয়। এর ফলে সম্রাট ও নবাব একেবারে ক্ষমতাহীন হয়ে ইংরেজদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়। রাজস্ব আদায়ের অধিকার এবং সেনাদল রাখার মতো অর্থবল ছিল না নবাবের। নবাবকে নামমাত্র সিংহাসনে বসিয়ে রেখে কোম্পানিই সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে বাংলায় কার্যত: ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তন ঘটে
২)অর্থনৈতিক সুবিধা :
বাংলায় দিউয়ানি লাভ ছিল কোম্পানির জন্য একটি বিরাট অর্থনৈতিক বিজয়। এর ফলে কোম্পানি নিজের দেউলিয়া অবস্থা হতে রক্ষা পায়। দিউয়ানি লাভের সুযোগ সুবিধা কোর্ট অব ডিরেক্টসকে জানতে গিয়ে লর্ড ক্লাইভ উল্লেখ করেন যে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা থেকে যে রাজস্ব পাওয়া যাবে তা দিয়ে সম্রাট ও নবাবের নির্ধারিত ভাতা ও অন্যান্য সামরিক ও বেসামরিক ব্যয় বাদ দিলেও কোম্পানির হাতে প্রকৃত আয় থাকবে ১২ কোটি টাকারও অধিক।
৩)কোম্পানির পুঁজি বৃদ্ধি :
লর্ড ক্লাইভ এক পত্রে কোর্ট অব ডিরেক্টসকে জানিয়েছিলেন যে, ঐ উদ্বৃত্ত রাজস্ব কোম্পানির গোটা বাণিজ্য বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট। ফলে দিউয়ানি লাভের আগে এ দেশে বাণিজ্য করার জন্য ইউরোপ হতে কোম্পানি যে বিপুল পুঁজি নিয়ে আসতো দিউয়ানি লাভের পর তার আর প্রয়োজন থাকে না এবং ব্যবসার সমস্ত পুঁজি প্রদেশের রাজস্ব হতেই সংগ্রহ করা হয়।
৪)অবাধ বাণিজ্য:-
বাংলায় দিউয়ানি লাভের ফলে কোম্পানির কর্মচারীরা শুল্কহীন অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ পায়। এতে কোম্পানির কর্মচারীদের অর্থের লোভ দিন দিন বাড়তে থাকে। অসদুপায়ে রাজস্ব আদায় করলেও কোম্পানির কর্তারা কোন পদক্ষেপ নিতেন না। এভাবে অর্থনৈতিক শোষণের ফলে এদেশের মানুষের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায়।
৫)সম্পদ পাচার(Drain of Wealth):-
কোম্পানির দিউয়ানি লাভের পর বাংলা থেকে ব্যাপকভাবে অর্থ ও সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার হতে থাকে। তাই ১৭৬৫ সালে বাংলার দিউয়ানি লাভ প্রকৃত অর্থে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। এর ফলে বাংলা ধীরে ধীরে অর্থশূন্য হয়ে পড়ে। একটা পর্যায়ে এসে এদেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসে।
★উপসংহার
বাংলার গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস মহীশূরের যুদ্ধে টিপু সুলতান কে তৃতীয় ইঙ্গ মহিশুরের যুদ্ধে (১৭৯২)পরাজিত করেন।
গভর্নর জেনারেল স্যার জন শরের (১৭৯৩-১৭৯৮) শাসনকালে এলাহাবাদের দূর্গটি কোম্পানি দখল করেন। লট ওয়েলেসলি ১৭৯৯ সালে চতুর্থ ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধ টিপু সুলতান কে পরাজিত ও নিহত করে পুরো মহীশূর দখল করে। ওয়েলেসলি দেশীয় রাজ্যগুলি কে বিনা যুদ্ধে ইংরেজ কোম্পানির আশ্রিত রাজ্যে পরিণত কার উদ্দেশ্যে অধীনতা মূলক মৈত্রী নীতি ঘোষণা করেন। এটির শর্তগুলি হল
১) কোম্পানির কিছু সৈন্য ঐ রাজ্যকে রাখতে হবে।
২) ঐ রাজ্যের রাজধানীতে একজন ইংরেজ রেসিডেন্ট থাকবে।
৩) ঐ রাজ্যের রাজা কোম্পানির অনুমতি ছাড়া অন্য কোন রাজ্যের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারবে না।
হায়দ্রাবাদের নিজাম ও অযোধ্যা সুরাট তাঞ্জরে শাসকগণ ও মারাঠাদের অধিনায়ক কচুয়া দ্বিতীয় বাজিরাও এই মৈত্রী নীতিতে আবদ্ধ হয়।
লর্ড হেস্টিংসের (১৮১৩-১৮২৩) শাসনামলে নেপাল কে কোম্পানি পরাজিত করেন। আয়নের হেস্টিংস ও লর্ড হেস্টিংস কোন মোগল সম্রাটের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করলেও ১৮৩৫ পর্যন্ত কোম্পানির মুদ্রায় মুঘল সম্রাটের নাম থাকত।
লর্ড ডালহৌসি স্বত্ব লোপ নীতি (doctrinet of lapse) সতারা ঝাঁসি নাগপুর উদয়পুর শংকরপুর প্রভৃতি রাজ্য দখল করেন। এই নীতির মূল কথা হলো কোম্পানির রক্ষণাধীন কোন দেশীয় রাজ্যের রাজা ও পুত্র অবস্থায় মারা যান তবে কোম্পানির অনুমতি ছাড়া কোন দত্তক পুত্র উত্তরাধিকারী হিসাবে নিতে পারবেনা। রাজ্যটি ইংরেজ কোম্পানির অধীনে চলে যায়।
১৮০৮ থেকে ১৮১৮ পর্যন্ত কোম্পানি (Dominent Possission লাভ করেন। এই সময় থেকে ভারতের শুরু হয় ইংরেজ কোম্পানির সার্বভৌমত্বের যুগ এই দেশে তাদের উপনিবেশিক শাসন ছিল শোষণ ধর্মীয়। তাই তারা এদেশে তাদের শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ওপর নির্ভর করত।
গ্ৰন্থ পঞ্জিকা
২) মোর্তজা, গোলাম আহমাদ। চেপে রাখা ইতিহাস। ঢাকা: মুনশি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ রিসার্চ একাডেমী, ২০১০ ।
৩) ঘোষ, এস। আধুনিক ভারতের ইতিহাস। কলকাতা: উসা পাবলিশিং হাউস
৪) মল্লিক,সমর কুমার। আধুনিক ভারতের দেড়শো বছর। কলকাতা: ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্স, ২০১৭ ।
৬) চট্টোপাধ্যায়, তপনমোহন। পলাশীর যুদ্ধ। কলকাতা: নাভানা। ১৯৫৬ ।
৭) ইনাম-উল-হক, ড. মুহাম্মদ। ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাস। ঢাকা: জাতীয় গ্ৰন্থ প্রকাশন ,২০১৭ ।
কোন মন্তব্য নেই: