এক নজরে সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মাদ শাহ্ ~ ইসলাম পরিচয়

 এক নজরে সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মাদ শাহ্

------ লিখেছেন : রাজিত তাহমীদ জিত

শাহী উপাধিসহ নাম- জালাল-উদ-দ্বীন মুহাম্মাদ শাহ্
জন্মগত নাম- যদু নারায়ণ রায় (জিৎমল্ল রায়)

ইসলাম গ্রহণ পরবর্তী নাম- মুহাম্মাদ জালাল

পিতা- রাজা গণেশ
মাতা- মহারানি ত্রিপুরা সুন্দরী দেবী

জন্মস্থান- ভাতুড়ীয়া একটাকিয়া জমিদারবাড়ি, ভাতুড়ীয়া পরগনা, বাঙ্গালাহ্ সালতানাত

[ বর্তমান- গড় ভবানীপুর খোর্দ, ভাতুড়িয়া, উপজেলা- রাণী শঙ্কাইল, ঠাকুরগাঁও জেলা, বাংলাদেশ ]

জাতিসত্তা- বাঙালি [আর্য]

স্ত্রীগণ- ১.বেগম আসমানতারা সুলতানা [সম্রাজ্ঞী ]
২. নবকিশোরী

সন্তান- ১. সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ্ শামসউদ্দিন আহমাদ শাহ্ [ বেগম আসমানতারা সুলতানার গর্ভে]
২. রাজা অনুপনারায়ণ রায় [ নবকিশোরী দেবীর গর্ভে]

সমাধি- একলাখী সমাধিসৌধ, হযরত পান্ডুয়া, মালদহ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

★ রাজত্বকালঃ ১৪১৫-১৪১৬ খ্রিস্টাব্দ ও ১৪১৮-১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দ

১ম সিংহাসন আরোহণ:
১৪১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সিংহাসনে আরোহণ করেন ।

২য় সিংহাসন আরোহণ: ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় পিতা গণেশ কে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।

বিজয়াভিযান-
১. শাহজাদা নাসিরের আনুগত্য স্বীকার- ১৪১৯ সাল
২. যাউনপুরের শিয়া ধর্মাবলম্বী শার্কীদের থেকে বিহার পুনর্বিজয় ১৪১৯ খ্রিস্টাব্দ
৩. ত্রিপুরা পুনর্বিজয়- ১৪২৯ খ্রিস্টাব্দ
৪. আরাকান বিজয়- ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ

অবদান :
গণেশ কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ ও ইসলামি স্থাপত্য সমূহ পুনর্নির্মাণ, ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটান। তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতায় আরাকান বাংলার অংশে পরিণত হয়। আরাকানের রাজা নরমিখলাকে তিনি সিংহাসনে বসান ও আরাকান রাজ ইসলাম গ্রহণ পূর্বক "মুহাম্মাদ সুলাইমান শাহ" নাম গ্রহণ করেন।

তিনি তাঁর পিতার কুকর্মের সহযোগী সন্ত্রাসী ব্রাহ্মণদের কে মৃত্যুদণ্ড থেকে রক্ষা পাবার জন্য ইসলাম গ্রহণের শর্ত দেন। তিনি উগ্র ব্রাহ্মণদের "কুরআন অথবা মৃত্যু" যেকোনো একটি বেছে নিতে বলেন। তিনি কুকর্মী ব্রাহ্মণদের শাস্তি হিসেবে জোর করে গরুর মাংস গোস্ত খাইয়ে দেন। তাঁর ক্রোধানল থেকে বাঁচতে ব্রাহ্মণরা আসামের জঙ্গলে পালিয়েছিলো।

ফ্রান্সিস বুকানন লিখেছেন-

[ জালালউদ্দিন মুহাম্মাদ শাহর সময়ে যত মানুষ মুসলিম হয়েছিলো তা বিগত একশো বছরে বাংলায় হয় নি।
তাঁর ভয়তে ব্রাহ্মণরা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসামের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলো ]

জালালউদ্দিন মুহাম্মাদ শাহ ছিলেন মহান উদার সুলতান। মুহাম্মাদ কাসিম ফিরিশতা তাঁকে ধর্মীয় উদারতার জন্য " যুগের খসরু" (সাসানি সম্রাট প্রথম খসরু) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সুলতান ছিলেন সংস্কৃত সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। বর্ধমানের ব্রাহ্মণ বৃহস্পতি মিশ্রকে তিনি সভাপণ্ডিত নিযুক্ত করেছিলেন। বৃহস্পতি মিশ্রের ছেলে বিশ্বরায়কে মন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছিলেন। মুহাম্মাদ শাহর সেনাবাহিনীর অন্যতম সেনাপতি ছিলেন রাজ্যধর নামের এক হিন্দু ব্যক্তি। অসংখ্য ব্রাহ্মণ কবি সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত ছিলেন।
সুলতান মামলুক সুলতান কে উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন এবং মিং সম্রাট ও তৈমুরী আমির শাহরুখ মির্জার সাথে সুসম্পর্ক বৃদ্ধি করেন। মামলুক সুলতানের পাঠানো উপঢৌকন রাজধানী ফিরুজাবাদে পৌঁছানোর আগেই সুলতান মৃত্যুবরণ করেন।

ব্যক্তিগত জীবন:

ভাতুড়ীয়া একটাকিয়া জমিদার বাড়িতে, বর্তমান বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁওয়ের রাণী শঙ্কাইল উপজেলার ভাতুড়ীয়ায় রানি ত্রিপুরা দেবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন যদু। কাসিম ফিরিশতা লিখেছেন- "ইহার নাম জিতমল্ল"
৪০০ বছরের পুরনো একটি বারেন্দ্রী ব্রাহ্মণ জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
তাঁর পরিবার শাহী বাঙ্গালা সালতানাতের অধীনস্থ ভূ-স্বামী ছিলো। যদু যৌবনে মল্ল যুদ্ধে পারদর্শী হয় "যদুমল্ল" বা "জিতমল্ল" নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।
তাঁর সাথে কৈশোরে রাজনৈতিক সন্ধি স্থাপনের লক্ষ্যে সাঁতাড়া পরগনার জমিদারের মেয়ে নবকিশোরীর বিবাহ হয় এবং তাঁর গর্ভে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র অনুপ জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

তাঁর ইসলাম গ্রহণের ও কাফির পিতাকে হত্যা করে বাঙালি মুসলিমকে রক্ষা করার নেপথ্যে সুফিসাধকবৃন্দের পাশাপাশি যাঁর অবদান ছিলো মুখ্য, তিনি আসমানতারা সুলতানা, সুলতান গিয়াস-উদ-দ্বীন আজম শাহের একমাত্র কন্যা এবং সুলতান নাসির-উদ-দ্বীন মাহমুদ শাহর বড় বোন। ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসার পরপরই শাহজাদির সাথে তাঁর বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় এবং
১৪১৯ সালে শাহর-ই-নাওতে শাহজাদা নাসিরের (ভবিষ্যত সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ) রাজপ্রতিনিধি খান জাহান আলী মুহাম্মাদ আল-খালিদী মুহাম্মাদ শাহর আনুগত্য স্বীকার করেন ও কৃতজ্ঞতাস্বরূপ শাহর-ই-নাওয়ের নাম রাখেন মুহাম্মদাবাদ।

সুলতানের ১ম স্ত্রী নবকিশোরী ও মা রানি ত্রিপুরাসুন্দরী দেবী ইসলাম গ্রহণ করেন নি। তারা ভাতুড়িয়ার রাজবাড়িতেই অবস্থান করেন এবং রানি ত্রিপুরাসুন্দরী ভাতুড়িয়া জমিদারির দেখাশোনা করতে থাকেন।
এরপর অনুপনারায়ণ রায় ভাতুড়ীয়ার রাজা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বাংলা সালতানাতের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের সাথে দায়িত্ব পালন অব্যহত রাখেন।
জালালউদ্দিন মুহাম্মাদ শাহর ইন্তিকালের পর তাঁর পুত্রসুলতান শামসউদ্দিন আহমাদ শাহ্ ১৪৩৩ সালে সিংহাসনে বসেন। রাজা অনুপনারায়ণ রায় সুলতানের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের সাথে রাজ্য পরিচালনা করেন। আহমাদ শাহর সাথে সৎ ভাই অনুপের সদ্ভাব ছিলো।
অনুপ রায় দীর্ঘ ৬৪ বছর ভাতুড়িয়ায় রাজত্ব পরিচালনা করেছিলেন।
আহমাদ শাহ ১৪৩৬ সালে নিহত হলে শাহজাদা নাসির প্রজা ও আমিরদের ডাকে সাড়া দিয়ে মুহাম্মাদাবাদ থেকে ৬০ হাজার সৈন্যসহ ফিরুজাবাদে এসে ক্ষমতাগ্রহণ করেন।
--------------------
বেগম আসমানতারা সুলতানা তাঁর স্বামী সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মাদ শাহ ও তাঁর পুত্র আহমাদ শাহর ইন্তিকালের পরে পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশের প্রথম সুলতান তাঁর ভাই নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহর রাজত্বকালে রাজকার্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি তাঁর ভাইয়ের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও শাহী হারেমের কর্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি ভাতুড়ীয়ার জমিদার অনুপরায়ের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরামর্শকও ছিলেন। প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য করতেন। নবকিশোরীর মৃত্যুর পর অনুপ রায় তাঁকেই মা বলে ডাকতেন, মায়ের মতো শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে। সুলতান বারবাক শাহর রাজত্বকালের শুরুর দিকে সুলতানার মৃত্যুর পর তাঁকে একলাখী মাকবারায় সমাহিত করা হয় রাজকীয় মর্যাদায়।

-----------------------------------------------------------
লেখক : রাজিত তাহমীদ জিত
copy from মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা fb
-----------------------------------------------

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.