আয়েশার (রাঃ) দাম্পত্য জীবনঃ পর্ব নম্বর-১ |
এই টপিকটি একটি মজার কথা বলে শুরু করছি। দেখবেন বহু মানুষ হযরত আয়েশা (রাঃ) এর বিবাহের বয়স নিয়ে কটাক্ষ করে। হযরত আয়েশা (রাঃ) যে ছোট বয়সে বিবাহ করেছিলেন সেটা তিনি স্বয়ং নিজেই উল্লেখ করেছেন (বুখারির হাদিস)। কটাক্ষকারী এই হাদীসটিকে তো গ্রহণ করে কিন্তু সেই আয়েশায় (রাঃ) যে রাসূল (সাঃ) এর সঙ্গে তাঁর সুন্দর দাম্পত্য জীবনের শতশত হাদীস বর্ণনা করেছেন সেটি সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। এটাই হলো তাদের হিপোক্রেসি। যে হাদীসগুলো তাদের স্যুট করে সেগুলো নেবে আর যেগুলো স্যুট করে না সেগুলো বর্জন করবে। যে বিবাহ করেছে তাঁর কোন প্রবলেম নেই, সে সুখে আছে কিন্তু যত সমস্যা এই বাটপারদের হচ্ছে।
তো যাই হোক আজকের পোস্টে আমি হযরত আয়েশা (রাঃ) এবং রাসূল (সাঃ) এর দাম্পত্য জীবন নিয়ে কিছু হাদিস নিয়ে এসেছি। একসাথে সমস্ত হাদিস উল্লেখ করলে পোস্টটি দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে এবং আপনারাও পড়ার ধৈর্য হারাবেন, তাই কয়েকটি পর্ব আকারে পোস্টগুলি দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ। অবশ্যই সময় করে পড়বেন এবং অন্যের কাছে পৌঁছে দেবেন ইনশাআল্লাহ, কারণ আজকের দিনে এই টপিকটি আপনাকে জানতেই হবে।
১. আয়েশা (রাঃ ) এর প্রতি রাসূল (সাঃ) এর গভীর ভালোবাসার প্রকাশ:
ক. কোন একদিন তিনি ভরা মজলিসে অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ আমর ইবনুল আস (রাঃ) বলে উঠলন,
“হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কাকে বেশি ভালোবাসেন?”
উত্তরে লজ্জা বা জটিলতার কোন ইঙ্গিত নেই:
রাসূল (সাঃ) বলে উঠলেন "আয়েশা"
একই প্রশ্ন আয়েশা (রাঃ) তাদের বিবাহের শুরুতে জিজ্ঞাসা করেছিলেন:
"আপনি আমাকে কিভাবে ভালোবাসেন?"
রাসূল (সাঃ) উত্তরে বলেছিলেন, "জটবদ্ধ গিঁটের মতো।"
তিনি যে উত্তর পেয়েছিলেন তাতে আয়েশা (রাঃ) এতটাই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে পরবর্তী বছরগুলিতে তিনি প্রায়শই তাঁর প্রশ্নটি পুনরাবৃত্তি করেন। পরবর্তীতে আয়েশা (রাঃ) ঠিক এইভাবে রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করতেন,
“হে আল্লাহর রাসূল! জট বাঁধা গিঁট এখন কি অবস্থায় আছে?"
আল্লাহ রাসূল (সাঃ) তখন উত্তরে বলতেন,
"প্রথম দিনের মত!"
[রেফারেন্সঃ বুখারী, ৩৪০০(ই.ফা); M. Yusuf Kandahlawi, Hayat’us-Sahaba, III/l00;
Ataullah b.Fadlullah, Ravdat’ul-Ahbab, p.360]
খ. আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ আমি যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রফুল্ল চেহারায় দেখতে পেলাম, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। রাসূল (সাঃ) বললেন, হে আল্লাহ, আয়েশা (রাঃ) এর অতীত ও ভবিষ্যতের গুনাহ, গোপনে ও প্রকাশ্যে গুনাহ ক্ষমা করে দিন। আয়েশা এত হাসলেন যে তাঁর মাথা তাঁর কোল থেকে পড়ে গেল। নবী তাকে বললেন, আমার দোয়া কি তোমাকে খুশি করে? আয়েশা (রাঃ) বললেন, আপনার দোয়া আমাকে খুশি করবে না কেন? রাসূল (সাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম, প্রত্যেক সালাতে আমার উম্মতের জন্য আমি এই দোয়া করে থাকি।
[রেফারেন্সঃ সহীহ ইবনে হিব্বান ৭২৬৬]
গ. মদিনায় তাঁর এক প্রতিবেশী, একজন পার্সিয়ান, নবী মুহাম্মদ (সাঃ) কে তার সাথে ডিনারের জন্য তৈরি একটি বিশেষ স্যুপ ভাগ করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। আয়েশাকে (রাঃ) বোঝাতে তিনি বলেন:
"আমার স্ত্রী কি আসতে পারে?" কিন্তু সেই পার্সিয়ান চায় না তিনি আসুক। তাই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) খাবার খেতে যান নি। কিছুক্ষণ পর, আবার সেই ব্যক্তি এসে তার আমন্ত্রণ পুনরাবৃত্তি করে। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) আবার জিজ্ঞাসা করলেন:
"আমার স্ত্রীর সাথে একসাথে?" সেই পার্সিয়ান ব্যক্তিটি আবার ভ্রুকুটি করে। কিছুক্ষণ পরে, সেই ব্যক্তিটি তৃতীয়বার তার আমন্ত্রণ পুনরাবৃত্তি করে। কিন্তু নবী মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর মনোভাব পরিবর্তন করলেন না। তিনি বললেন: "আমার স্ত্রীও..."
তৃতীয়বারের মাথায় সেই ব্যক্তিটি রাজি হয়ে গেল। অতঃপর তারা দুজনেই উঠলেন এবং একজনের পিছনে আর একজন চলে তার বাড়িতে এসে পৌঁছলেন।
[রেফারেন্সঃ সহিহ মুসলিম, ৫১৩৯ (ই.ফা);
Ed: Prof. Dr. İ. Lütfi Çakan, Hz. Peygamber ve Aile Hayatı, p.210.]
দেখুন কিভাবে রাসূল (সাঃ) প্রকাশ্যে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) এর প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত করেছেন।
২. রাসূল (সাঃ) এর প্রতি আয়েশা (রাঃ) এর গভীর ভালবাসার প্রকাশ:
ক. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: একবার (জাহেলী যুগে) এগারজন মহিলা একত্রিত হয়ে এ প্রতিজ্ঞা করল যে, তারা তাদের স্বামীদের কোনো ভাল-মন্দ ও দোষ-ত্রুটির কথা গোপন করবে না। (অর্থাৎ তারা এ সব কথা বৈঠকে আলোচনা করবে)। .. দীর্ঘ হাদিস.. ১১ জনের মধ্যে একজন ছিলেন উম্মে যারা। তিনি তাঁর স্বামী আবু যারা সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করেন এবং তাঁর স্বামীর ভূয়শী প্রশংসা করতে থাকেন।
উক্ত ঘটনা রাসূল (সাঃ) এর কাছে আয়েশা (রাঃ) শোনান। এর এর উত্তরে রাসূল (সাঃ) বলেন, “হে আয়েশা! আমি তোমার জন্য ভালোবাসা ও ওয়াদাপূরণে উক্ত আবু যারার মত হবো, তবে বিচ্ছিন্নতা ও দেশান্তরে তার মত হবো না”
এটা শুনে আয়েশা (রাঃ) বলেন: “হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বরং আপনি আবু যারার চেয়ে আমার নিকট অধিক উত্তম”।
দেখুন আয়েশা (রাঃ) কিভাবে রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত করেছেন উক্ত হাদীসে।
[রেফারেন্সঃ বুখারী, হাদীস নং ৫১৮৯, মুসলিম, হাদীস নং ২৪৪৮, নাসায়ী: হাদীস নং ৯০৮৯]
খ. ৫ম হিজরীতে খন্দক যুদ্ধের পর বনু কুরায়যার বিজয় এবং গণীমতের বিপুল মালামাল প্রাপ্তির ফলে মুসলমানদের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে। এ প্রেক্ষিতে পবিত্রা স্ত্রীগণ রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে তাদের ভরণ-পোষণের পরিমাণ বৃদ্ধির আবেদন জানান। এতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মর্মাহত হন এবং তাদেরকে তালাক গ্রহণের এখতিয়ার প্রদান করেন। উক্ত মর্মে আয়াতে ‘তাখয়ীর’ (آية التخيير) নাযিল হয় (আহযাব ৩৩/২৮-২৯)। যেখানে বলা হয়, "হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে বল, ‘যদি তোমরা দুনিয়ার জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা কর তবে আস, আমি তোমাদের ভোগ-বিলাসের ব্যবস্থা করে দেই এবং উত্তম পন্থায় তোমাদের বিদায় করে দেই’। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও পরকালীন নিবাস কামনা কর, তবে তোমাদের মধ্য থেকে সৎকর্মশীলদের জন্য আল্লাহ অবশ্যই মহান প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন"
উক্ত আয়াত নাযিলের পর রাসূল (সাঃ) আয়েশাকে তাঁর পিতা-মাতার সঙ্গে পরামর্শ করতে বললে তিনি বলে ওঠেন, এজন্য পিতা-মাতার সাথে পরামর্শের কি আছে? আমি তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং আখেরাতকে কবুল করে নিয়েছি’। তিনি বলেন, অতঃপর অন্যান্য স্ত্রীগণ সকলেই আমার পথ অনুসরণ করলেন’।
উক্ত হাদিস থেকে বোঝা যায় যে কিভাবে আয়েশা (রাঃ) দুনিয়ার প্রাচুর্যতা ত্যাগ করে রাসূলকে নিজের জন্য মনোনীত করে নিয়েছিলেন।
[ রেফারেন্সঃ বুখারী হা/৩৫৫৬; মিশকাত হা/৫৭৯৮ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ২ অনুচ্ছেদ]
আয়েশার (রাঃ) দাম্পত্য জীবন || পর্ব নম্বর-২ ||
এর আগের পর্বে দুইটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলাম,
১. আয়েশা (রাঃ ) এর প্রতি রাসূল (সাঃ) এর গভীর ভালোবাসার প্রকাশ,
২. রাসূল (সাঃ) এর প্রতি আয়েশা (রাঃ) এর গভীর ভালোবাসার প্রকাশ।
আজকের পর্বে এরপর থেকে শুরু করছি।
৩. রাসূল (সাঃ) কর্তৃক আয়েশা (রাঃ) এর জন্য বৈধ বিনোদনের ব্যবস্থা করা:
ক. আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা হাবশীরা বর্শা-বল্লম নিয়ে মসজিদে খেলা করছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ’’হে হুমাইরা! তুমি কি ওদের খেলা দেখতে চাও?’’ আমি বললাম, ’হ্যাঁ।’ তখন তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি আমার থুত্নিকে তাঁর কাঁধের উপর রাখলাম এবং আমার চেহারাকে তাঁর গালের সাথে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। (বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর) তিনি বললেন, ’’যথেষ্ট হয়েছে, চল এবারে।’’ আমি বললাম, ’হে আল্লাহর রাসূল! তাড়াতাড়ি করবেন না।’ তাই তিনি আমার জন্য আবারও দাঁড়িয়ে গেলেন। অতঃপর আবার বললেন, ’’যথেষ্ট হয়েছে, চল এবারে।’’ আমি বললাম, ’হে আল্লাহর রাসূল! তাড়াতাড়ি করবেন না।’ আমার যে তাদের খেলা দেখার খুব শখ ছিল তা নয়, বরং আমি কেবল তাঁর অন্যান্য স্ত্রীদেরকে এ কথাটা জানিয়ে দিতে চাইছিলাম যে, আমার কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কতটা মর্যাদা ছিল এবং তাঁর কাছে আমার কতটা কদর ছিল।
[রেফারেন্স: নাসাঈ কুবরা ৮৯৫১, সহিহ মুসলিম ১৯৩৯ (ই.ফা)]
খ. আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক দিন তাঁর কাছে গেলেন। তখন তাঁর সামনে দুইটি বালিকা দফ বাজাচ্ছিল (বুয়াসের ঘটনার নাশিদ পড়ছিল)। আবূ বকর (রাঃ) তাদের নিষেধ করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাদের নিষেধ করো না। কেননা প্রত্যেক জাতির জন্যই একটি আনন্দ স্ফূর্তির দিন থাকে ( ঈদের দিনের কথা বলা হয়েছে)।
[রেফারেন্স: সুনানে নাসাঈ, ১৫৯৬; সহিহ মুসলিম, ১৯৪০]
গ. আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তিনি এক সময়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে সফরে ছিলেন। তিনি বলেন, তখন আমি তাঁর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতায় তাঁর আগে বেড়ে গেলাম (অর্থাৎ জিতে গেলাম), তারপর যখন আমি মোটা স্থুলকায় হয়ে গেলাম, তখন পুনরায় তাঁর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলাম। তখন তিনি আমার আগে বেড়ে (জিতে) গেলেন। তখন তিনি বললেন, এটা তোমার প্রথমবারে জেতার বদলা।
দেখুন রাসূল (সাঃ) এবং হযরত আয়েশা (রাঃ) এর দাম্পত্য জীবন কতই না সুন্দর ছিল।
[রেফারেন্স: সূনান আবু দাউদ, ২৫৭০ (ই.ফা)]
ঘ. আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা সাওদা বিনতে যামআ’ আমার সাথে দেখা করতে আমার বাসায় এলো। রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ও আমার মাঝখানে বসে গেলেন। তাঁর একটি পা আমার কোলে, আর একটি পা সাওদার কোলে ছিল। আমি তার (সাওদার) জন্য ’খাযীরা’ (গোশ্ত ছোট ছোট করে কেটে তাতে আটা মিশিয়ে রান্না করা খাবার) তৈরী করলাম। অতঃপর তাকে খেতে বললে সে খেতে অস্বীকার করল। আমি বললাম, ’তুমি অবশ্যই খাবে, নচেৎ আমি তোমার মুখে তা লেপে দেব।’ সে অস্বীকার করলে আমি প্লেট থেকে সামান্য পরিমাণ নিয়ে তার মুখে লেপে দিলাম।
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কোল থেকে স্বীয় পা সরিয়ে নিলেন, যাতে সে আমার কাছ থেকে বদলা নিতে পারে। অতঃপর আমি প্লেট থেকে আরো কিছু নিয়ে আমার মুখে লেপে নিলাম। তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসতে লাগলেন। ইত্যবসরে উমার (রাঃ) উপস্থিত হয়ে বলতে লাগলেন, ’হে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার! হে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার!’ তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বললেন, তোমরা উঠে তোমাদের মুখ ধুয়ে নাও, আমার মনে হয় উমার প্রবেশ না করে ছাড়বে না।
দেখুন কতইনা সুখময় ছিল রাসূল (সাঃ) দাম্পত্য জীবন।
[রেফারেন্স: নাসাঈ কুবরা, ৮৯১৭; সিলসিলা সহীহাহ, ৩১৩১]
৪. আয়েশার (রাঃ) ফিলিংস বোঝা:
আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, আমি অবশ্যই জানতে পারি কখন তুমি আমার প্রতি খুশী থাক এবং কখন রাগান্বিতা হও। আমি বললাম, কী করে আপনি তা বুঝতে পারেন? তিনি বললেন, যখন তুমি আমার প্রতি খুশী থাক, তখন বল, না, মুহাম্মাদের রবেবর শপথ! আর যখন তুমি আমার প্রতি রেগে থাক, তখন বল, না, ইব্রাহীমের রবেবর শপথ! আমি তখন বললাম, ’হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর শপথ! আমি আপনার নাম ছাড়া আর কিছুই বাদ দিই না।
[রেফারেন্স: সহিহ বুখারী ৫২২৮, ৬০৭৮, সহিহ মুসলিম, ৬৪৩৮]
উপরোক্ত হাদীস গুলো থেকে কি বুঝলেন?? যারা হযরত আয়েশা (রাঃ) ও রাসূল (সাঃ) এর বিবাহ নিয়ে কটুক্তি করে তাদের বৈবাহিক জীবনে আদৌ কি এরকম সুখময়??
আয়েশার (রাঃ) দাম্পত্য জীবনঃ পর্ব নম্বর-৩ ||
৪. রাসূল (সাঃ) কিভাবে আয়েশার (রাঃ) রাগ ঠান্ডা করতেন!
একবার রসূলে করীম (সাঃ) ও হযরত আয়েশা (রাঃ)- এর মধ্যে কিছু কথা কাটাকাটি হলে তাঁরা উভয়েই হযরত আবু বকরের কাছে বিচারপ্রার্থী হন। রসুলুল্লাহ (সাঃ) হযরত আয়েশাকে বললেন তুমি আগে বলবে, না আমি বলব। হযরত আয়েশা আরজ করলেন আপনি বলুন, কিন্তু সত্য সত্য বলবেন। একথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) কন্যা আয়েশাকে সজোরে এক চপেটাঘাত করে বললেন : তুই কি বলছিস, হযরত কি সত্য ছাড়া মিথ্যা বলতে পারেন। হযরত আয়েশা রসূলূল্লাহ (সাঃ)-এর আশ্রয় চাইলেন এবং তাঁর পেছনে গিয়ে লুকালেন। রসূলে করীম (সাঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে বললেনঃ আমরা তোমাকে এজন্যে ডাকিনি এবং তুমি এরূপ করবে এটাও আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না।(এভাবে তিনি (সাঃ) আয়েশার (রাঃ) বিরুদ্ধে নালিশ করতে এসেও আয়েশার পক্ষপাতিত্ব করলেন)
একবার কোন এক কথায় রাগান্বিত হয়ে হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন, আপনিই বলেন, আপনি পয়গম্বর। রসূলুল্লাহ (সাঃ) মুচকি হেসে তা সহ্য করে নিলেন।
[রেফারেন্সঃ এহইয়াউ উলুমিদ্দীন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা নং- ২৭৪]
৫. কেমন ছিল আয়েশা (রাঃ) এবং রাসূল (সাঃ) এর সংসার !!
ক. আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ আল্লাহর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পথে জিহাদ করা ব্যতীত, কখনো নিজের হাত দিয়ে কোন কিছুতে আঘাত করেননি, কোন নারী বা কোন দাসকেও আঘাত করেননি।
(এই হাদিস থেকে এটাই বোঝানোর উদ্দেশ্য যে রাসূল (সাঃ) কোনদিন কোন নারীর গায়ে হাত তোলেন নি)
[রেফারেন্সঃ সহিহ মুসলিম, ২৩২৮ (ইন্টারন্যাশনাল)]
খ. একদা সা'দ ইবনে হিশাম ইবনে আমের (রাঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে মুমিনদের মা, আমাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর চরিত্র সম্পর্কে বলুন। তিনি বললেনঃ তুমি কি কোরান পড় না? আমি বললামঃ হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চরিত্র ছিল কুরআন।
[রেফারেন্সঃ সহিহ মুসলিম, ৭৪৬ (ইন্টারন্যাশনাল)]
গ. উরওয়াহ বলেন, আয়েশা (রাঃ)-কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, ’রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি ঘরে কাজ করতেন?’ তিনি বললেন, ’রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য মানুষের মত একজন মানুষ ছিলেন; স্বহস্তে কাপড় পরিষ্কার করতেন, পশু হতে দুধ দোহাতেন এবং নিজের খেদমত নিজেই করতেন। অন্যন্য পুরুষরা যেমন নিজেদের বাড়ীতে কাজ করে, অনুরূপ তিনিও তাঁর কাপড়ে তালি লাগাতেন এবং জুতো সিলাই করতেন।
[রেফারেন্সঃ সহীহ আদাবুল মুফরাদ ১/২১৫, সহীহুল জামে, ৯০৬৮]
ঘ. আসওয়াদ বলেন, আমি আয়েশা (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে কী করতেন? উত্তরে তিনি বললেন, ’তিনি সাংসারিক কাজ করতেন। অতঃপর নামাযের সময় হলে নামাযের জন্য বের হয়ে যেতেন।
[রেফারেন্সঃ সহিহ বুখারী ৬৭৬, ৫৩৬৩, ৬০৩৯]
ঙ. আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কোন খাবারের দোষ বর্ণনা করেননি। (খাবার সামনে এলে) রুচি (বা ইচ্ছা) হলে তিনি খেতেন, তা না হলে বর্জন করতেন।
[রেফারেন্সঃ সহিহ বুখারী, ৫৪০৯; সহিহ মুসলিম, ৫৫০৪]
আয়েশার (রাঃ) দাম্পত্য জীবনঃ পর্ব নম্বর-৪ ||
৫. আয়েশা (রাঃ) এবং রাসূল (সাঃ) এর সংসার কেমন ছিল?
এই মর্মে আগের পর্বে পাঁচটি হাদিস উল্লেখ করেছিলাম এই পর্বে ও কিছু হাদিস উল্লেখ করা হলো-
ক. হযরত আয়েশা (রাঃ) কে মহানবী (সাঃ) এর আচরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: “তিনি নম্র কথাবার্তা, হাস্যোজ্জ্বল মুখ এবং প্রফুল্ল মেজাজে সমস্ত পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন।”
[রেফারেন্সঃ সহিহ মুসলিম; মাওয়াহিব-উদ-দুনিয়া, খন্ড -১, পৃষ্ঠা নং. ২৯৩]
খ. হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ
“একদিন মহানবী (সাঃ) তাঁর জুতা মেরামত করছিলেন এবং আমি চরকায় কাজ করছিলাম। আমি যখন উপরে তাকালাম তখন দেখলাম যে, মহানবী (সাঃ) এর কপাল ঘামে ঝলমল করছে এবং আমি তাঁর কপালে একটি আলো দেখতে পেলাম, যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং ছড়িয়ে পড়ে। এটা একটি চোখ জুড়ানো দৃশ্য ছিল! আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলাম। মহানবী (সাঃ) মুখ তুলে তাকালেন এবং জিজ্ঞেস করলেনঃ আয়েশা (রাঃ) তুমি এত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছো কেন?’ আমি বললামঃ হে আল্লাহর নবী! আমি দেখলাম আপনার কপাল ঘামে চিকচিক করছে আর তাতে আলো জ্বলছে। আমি সম্পূর্ণ মন্ত্রমুগ্ধ ছিলাম। আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে শপথ করছি যে, কবি আবু কাবীর হাজলি যদি আপনাকে দেখতে সক্ষম হতেন, তবে তিনি বুঝতে পারতেন যে আপনিই তাঁর কবিতার প্রকৃত চিত্রায়ন, এবং আমি নিম্নলিখিত কবিতার পঙক্তি গুলি পড়লাম:
"তিনি জন্ম বা বৃদ্ধির কোনো ক্ষতিকর অবশিষ্টাংশ থেকে মুক্ত। আপনি যখন তাঁর আলোকিত ভ্রুটির ভাঁজগুলি দেখেন তখন আপনি তাঁর মুখটি বিদ্যুতের বিশুদ্ধ ঝলকের চেয়ে উজ্জ্বল মহিমায় উজ্জ্বল দেখতে পান।"
হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ
"রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একথা শুনে তাঁর হাতে যা ছিল তা নামিয়ে দিলেন এবং তাঁর কপালে চুমু দিলেন এবং বললেন: 'তুমি আমাকে সর্বাধিক খুশি করেছ।'
[রেফারেন্সঃ মাদারিজ আস-সালিকীন, ইমাম ইবনে কাইয়িম (রহ.), পৃষ্ঠা নং-১৭৭]
গ. আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন (অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য) গোসল করতাম, তখন আমাদের উভয়ের মাঝে একটাই পাত্র হত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাড়াতাড়ি করে (সেটা থেকে পানি নিতে) গেলে আমি বলতাম, ছাড়ুন আমি আগে নিই, ছাড়ুন আমি আগে নিই।
[রেফারেন্সঃ সহিহ মুসলিম, ৭৫৮; সহিহ বুখারী, ২৪৮(ই.ফা.)]
ঘ. আয়েশা (রাঃ) বলেন, ’আমি মাসিক অবস্থায় কোন কিছু পান করে সে পানপাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দিতাম। তিনি সেখানেই মুখ লাগিয়ে পান করতেন, যেখানে আমি মুখ লাগিয়ে ছিলাম। অনুরূপ আমি মাসিক অবস্থায় হাড় থেকে গোশ্ত ছিঁড়ে খেতাম। অতঃপর তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দিতাম। তিনি সেখানেই মুখ লাগিয়ে হাড় থেকে গোশত ছিঁড়ে খেতেন, যেখানে আমি মুখ লাগিয়ে ছিলাম।’
[রেফারেন্সঃ মুসনাদে আহমাদ, ২৪৩২৮;সহিহ মুসলিম, ৭১৮]
ঙ. আয়েশা (রাঃ) রাসূল (সাঃ) এর চুল আঁচড়ে দিতেন ||
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেনঃ আমি হায়েয অবস্থায় আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ)-এর মাথা আঁচড়ে দিতাম।
[রেফারেন্সঃ সহিহ বুখারী, ২৯৫ (তাওহীদ পাবলিকেশন)]
চ. রাসূল (সাঃ) আম্মাজান আয়েশা (রাঃ) এর কোলে মাথা রেখে কোরআন তেলাওয়াত করতেন ||
আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেনঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার কোলে হেলান দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আর তখন আমি হায়েযের অবস্থায় ছিলাম।
[রেফারেন্সঃ সহিহ বুখারী, ২৯৭ (তাওহীদ পাবলিকেশন)]
বিঃদ্রঃ উপরের হাদিস গুলিতে 'হায়েজ অবস্থায়' এটা কেন উল্লেখ করা হয়েছে জানেন??
-কারণ সমকালীন সময় হায়েজা বা ঋতুবতী মহিলাদেরকে ছোট চোখে দেখা হতো, তাদের এক ঘরে করে দেওয়া হতো, যখন তাদের হায়েজ আসতো তখন তাদের রান্না করতে দেওয়া হতো না এবং স্বামীর সংস্পর্শে আসা নিষেধ ছিল (ঋতুবতী অবস্থায় ইসলাম শুধু সহবাসকে হারাম করেছে, তার মানে এই নয় যে স্বামী স্ত্রী আলাদা থাকবে) যা এখনও বহু সমাজে দেখা যায়। উপরোক্ত হাদীসে রাসূল (সাঃ) ঋতুবতী মহিলাদের কে নিয়ে যে কুসংস্কার ছিল সেটার পরিসমাপ্তি করেছেন এবং হায়েজা তথা ঋতুবতী মহিলাদেরকেও তাদেরকে স্বীয় সম্মান দান করেছেন।
আয়েশার (রাঃ) দাম্পত্য জীবনঃ পর্ব নম্বর-৫ ||
৬. রাসূল (সাঃ) যেভাবে আয়েশা (রাঃ) এর রাগ মেটাতেন!
ক. হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : রসুলুল্লাহ (সাঃ) কোন এক সহধর্মিণীর (হযরত আয়েশা) গৃহে ছিলেন। এ সময় অন্য এক সহধর্মিণী (হযরত বয়নাব বিনতে জাহশ রাঃ) একটি পাত্রে করে তাঁর জন্য খানা পাঠালেন । তিনি যে স্ত্রীর ঘরে ছিলেন সে স্ত্রী (অর্থাৎ আয়েশা রাঃ) খাদেমের হাতে আঘাত করলে পাত্রটি মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে গেল । তখন রসুলুল্লাহ (সাঃ) পাত্রের ভাঙ্গা টুকরাগুলি একত্র করলেন। তিনি খাদ্যগুলো উঠিয়ে তাতে রাখছিলেন এবং (খাদেমকে) বলছিলেন, তোমার মায়ের আত্মমর্যাদায় ঘা লেগেছে। তারপর খাদেমকে বসিয়ে রেখে যার ঘরে তিনি ছিলেন তার কাছ থেকে একটি পাত্র আনিয়ে ঐ ভাল পাত্রটি ঐ স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন যার পাত্রটি ভেঙ্গে গিয়েছিল। আর যে ঘরে পাত্রটি ভেঙ্গে গিয়েছিল সেখানেই তা রেখে দিলেন।
এইভাবে তিনি আয়েশা (রাঃ) কে কোন কিছুই বললেন না বরং খাদেমকে রহস্য করে বললেন যে তোমাদের মা অর্থাৎ আয়েশা (রাঃ) এর আত্মমর্যাদায় লেগেছে।
[রেফারেন্সঃ সহিহ বুখারী, বিবাহ অধ্যায়, আত্মমর্যাদা অনুচ্ছেদ, ১১ খন্ড ২৩৭ পৃষ্ঠা]
খ. আবু ইয়ালা এবং বাযযার একটি হাসান সূত্রে আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, একদা রাসূল (সাঃ) আমার ঘরে প্রবেশ করে দেখলেন যে, আমি কাঁদতেছি। তখন তিনি বললেন, কিসে তোমাকে কাঁদাল? আমি বললাম, ফাতেমা আমাকে কটু কথা বলেছে। অতঃপর তিনি ফাতেমাকে ডাকলেন এবং বললেন, হে ফাতেমা। তুমি কি আয়েশাকে কটু কথা বলেছ? ফাতেমা বলল, হ্যাঁ হে আল্লাহর রাসূল। তখন তিনি বললেন, হে ফাতেমা! আমি যাকে ভালোবাসি তুমি কি তাকে ভালোবাস না? ফাতেমা বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমি যার ওপর রাগান্বিত হই তুমি কি তার ওপর রাগান্বিত হও না? ফাতেমা বলল, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, আমি আয়েশাকে ভালোবাসি। সুতরাং তুমি আয়েশাকে ভালোবাস। অতঃপর ফাতেমা (রাঃ) বলল, আমি আর কখনো আয়েশাকে এমন কথা বলব না, যার দ্বারা তিনি কষ্ট পান।
[রেফারেন্সঃ আয়েশা (রাঃ) সম্পর্কে ১৫০টি শিক্ষণীয় ঘটনা, পৃষ্ঠা নংঃ ১৭]
৭. আয়েশা (রাঃ) যেভাবে রাসূল (সাঃ) এর প্রশংসা করতেন ||
আগের পর্বগুলিতে এই সংক্রান্ত কিছু হাদিস উল্লেখ করেছি ,এই পর্বে আরো কিছু হাদিস উল্লেখ করলাম।
ক. আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো অশ্লীল বা অশ্লীলতা লালন-কারী ব্যক্তি ছিলেন না। হাট-বাজারে কখনো হৈচৈ করতেন না। আর মন্দের প্রতিদান মন্দ দ্বারা দিতেন না বরং তিনি ক্ষমা করে দিতেন।
[রেফারেন্সঃ মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২৫৪১৭]
খ. আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের মত এমন তাড়াতাড়ি কথা বলতেন না, এক নাগাড়ে কথা বলে যেতেন না। বরং তিনি স্পষ্ট ও ধীর স্থিরভাবে কথা বলতেন, তার বৈঠকে যারা উপস্থিত থাকত, সবাই তার কথাগুলি মুখস্থ করে ফেলত।
[রেফারেন্সঃ তিরমিযি, হাদিস: ৩৬৩৯]
গ. আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল। আপনার নিকট সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি কে? তখন তিনি বললেন, কেন? আমি বললাম, যাতে করে আপনি যাকে ভালোবাসেন আমিও তাকে ভালোবাসতে পারি। তখন তিনি বললেন, আয়েশা।
[রেফারেন্সঃ আয়েশা (রাঃ) সম্পর্কে ১৫০টি শিক্ষণীয় ঘটনা, পৃষ্ঠা নংঃ ৮২]
৮. রাসূল (সাঃ) যেভাবে আয়েশা (রাঃ) কে মর্যাদা দিয়েছেন:
ক. "আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন । সকল খাদ্য দ্রব্যের উপরে “সারীদের” যে মর্যাদা, সমগ্র রমনী কুলের উপরে আয়েশার মর্যাদা ঠিক তেমনি।"
[রেফারেন্সঃ সহিহ বুখারী, মানাকের অধ্যায়, আয়েশার (রা) ফযীলত অনুচ্ছেদ, ৮ খন্ড ১০৮ পৃষ্ঠা;
সহিহ মুসলিম, সাহাবাদের ফযীলত অধ্যায়, আয়েশার (রা) ফযীলত অনুচ্ছেদ, ৭ খন্ড, ১৩৮ পৃষ্ঠা]
খ. আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন: ...তারপর রসূলুল্লাহ (সাঃ) ফাতিমাকে লক্ষ্য করে) বললেন হেময়ী কন্যা, আমি যাকে ভালবাসি তুমি কি তাকে ভালোবাসনা? ফাতিমা বললেন জি, আব্বা। তিনি বললেন, তাহলে তুমিও একে (আয়েশাকে) ভালবাস।
[রেফারেন্সঃ সহিহ বুখারী, ৬ খন্ড, ১৩৪ পৃষ্ঠা;
সহিহ মুসলিম, সাহাবাদের ফযীলত অধ্যায় আয়েশার (রাঃ) ফযীলত অনুচ্ছেদ, ১ খন্ড, ১৩৫ পৃষ্ঠা]
গ. হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- একদা রসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে বললেন হে আয়েশা! জিবরাঈল তোমাকে সালাম জানাচ্ছেন।" আমি বললাম "তার উপর শান্তি ও আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক, আপনি তা দেখেন যা আমি দেখতে পাই না" (এই কথাটি তিনি আল্লাহর রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন)।
[রেফারেন্সঃ সহিহ বুখারী : সাহাবীদের গুণাবলী অধ্যায়, হযরত আয়েশার (রা) গুণাবলী অনুচ্ছেদ, ৮ খন্ড, ১০৭ পৃষ্ঠা; সহিহ মুসলিম, সাহাবীদের গুণাবলী অধ্যায়, হযরত আয়েশার (রা) গুণাবলী, অনুচ্ছেদ, ৭ খন্ড, ১৩৯ পৃষ্ঠা, সহিহ বুখারী, ৩৭৬৮(ইন্টারন্যাশনাল)]
৯. রাসূল (সাঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ) কে ভালবেসে মাঝে মাঝে ছদ্ম নামে ডাকতেন:
ক. আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ভালোবেসে কখনও কখনও আমার নাম হুমায়রা বা লাল গোলাপ বলে ডাকতেন।
[রেফারেন্সঃ ইবনে মাজাহ, ২৪৭৪]
খ. একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে বলেন: হে আয়েশ! [সংক্ষিপ্তাকারে] জিব্রাঈল [আলাইহিস সালাম] এই মাত্র তোমাকে সালাম দিয়ে গেল"
(এই হাদীসে রাসূল (সাঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ) কে আঈশ বলে সম্বোধন করেছেন)
[রেফারেন্সঃ সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৭৬৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৯৭৫]
উম্মুল মু'মেনীন আয়েশার (রাঃ) নামকে আদরাচ্ছলে সংক্ষিপ্ত
আয়েশার (রাঃ) দাম্পত্য জীবনঃ পর্ব নম্বর-৬ [শেষ পর্ব] :-
পঞ্চম পর্বের পর থেকে...
১০. রাসুল (সাঃ) ও আয়েশা (রাঃ) এর সাংসারিক জীবন থেকে একটি শিক্ষণীয় ঘটনা যেখানে প্রত্যেক স্বামীর জন্য একটি আদর্শ রয়েছে:
আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কাছে এসে বলতেন:
"তোমার নিকট খাবার কিছু আছে কি?" উত্তরে আয়েশা (রাঃ) বলতেন: না, অত:পর তিনি (সাঃ)বলতেন: তবে আমি আজ রোযাই রাখলাম।
[রেফারেন্সঃ তিরমিযি, হাদিস: ৭৩৪]
এ হাদীসটি ভালো করে লক্ষ্য করুন যে কিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্ষুধার্ত হয়ে ঘরে আসলেন কিন্তু কোন খাবার না পেয়ে তিনি আয়েশার (রাঃ) প্রতি মোটেই রাগান্বিত হলেন না বরং খেলার ছলে সুকৌশলে তিনি বলে ফেললেন "তবে আমি আজ রোযাই রাখলাম"। তাহলে চিন্তা করুন তাঁদের সংসারে কতইনা মাধুর্য ছিল। আজকাল দেখা যায় স্ত্রী রান্নাতে সামান্য ভুল করলে স্বামী তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে যায়, অনেক সময় ঝামেলা আরো দূর পর্যন্ত গড়ায়, আল্লাহ হেফাজত করুন। এই হাদীস থেকে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে উপস্থিত স্বামীরা শিক্ষা লাভ করতে পারেন 😂।
১১. আয়েশা (রাঃ) রাসুল (সাঃ) কে ঝাড়ফুঁক করতেন:
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোন অসুস্থতা অনুভব করতেন তখন তিনি নিজের উপর মুআওয়িযাত (আশ্রয়ণীয় সূরাগুলো) পড়ে ফুঁ দিতেন। যখন তাঁর ব্যথা তীব্র হল তখন আমি পড়ে তাঁকে ফু দিতাম এবং তাঁর হাত দিয়ে মাসেহ করতাম; তাঁর হাতের বরকতের আশায়।
[রেফারেন্সঃ সহিহ বুখারী, ৪৭২৮ ও সহিহ মুসলিম, ২১৯২]
এই হাদিস থেকেও তাঁদের দাম্পত্য জীবনের closeness বোঝা যায়।
১২. আয়েশা (রাঃ) রাসূল (সাঃ) এর স্ত্রী হিসেবে গর্ববোধ করতেন ||
ক. হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাঃ)-এর সহধর্মিণীগণের কেউই আমার উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারেনি,... (দীর্ঘ হাদিস)।
[রেফারেন্সঃ সহিহ বুখারী, আনসারদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলী অধ্যায়, ৮ খন্ড, ১৩৬ পৃষ্ঠা; সহিহ মুসলিম সাহাবীদের গুণাবলী অধ্যায়, হযরত খাদিজা (রা)-র গুণাবলী অনুচ্ছেদ, ৭ খন্ড, ১৩৪ পৃষ্ঠা]
খ. ইবনে সাদ আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমাকে এমন দশটি বৈশিষ্ট্য দেয়া হয়েছে যা রাসূল-এর কোনো স্ত্রীকে দেওয়া হয়নি। তখন তাকে বলা হলো সেগুলো কি? তিনি বললেন,
১. রাসূল আমাকে ছাড়া আর কাউকে বাকেরা (কুমারী) অবস্থায় বিবাহ করেননি।
২. তিনি আমাকে ছাড়া এমন কাউকে বিবাহ করেননি, যার পিতা-মাতা উভয়ে মুমিন ও মুহাজির।
৩. আমার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আকাশ থেকে আয়াত নাযিল হয়েছে।
৪. জিবরাঈল (আ) রাসূল -কে বলেন, তুমি তাকে বিবাহ কর। নিশ্চয় সে তোমার স্ত্রী।
৫. আমি এবং রাসূল এক সাথে এক পাত্রে গোসল করতাম।
৬. তিনি আমার কাছে থাকাবস্থায় ওহী নাযিল হতো।
৭. অন্য কোনো স্ত্রীর নিকট থাকাবস্থায় ওহি নাযিল হয়নি।
৮. আল্লাহ তায়ালা রাসূল কে আমার বুকের ওপর থাকাবস্থায় মৃত্যু দান করেন।
৯. তিনি এমন এক রাত্রিতে মৃত্যুবরণ করেন যে রাত্রিতে তিনি আমার নিকট অবস্থান করেন।
১০. তাকে আমার বাড়িতেই দাফন করা হয়।
আবু ইয়ালা (রহ.) এর বর্ণনায় আরও একটি অতিরিক্ত জিনিস পাওয়া যায়। সেটি হল- আয়েশা (রাঃ) বলেন,
আমি সুগন্ধি তৈরি করতাম এবং তা রাসূল (সাঃ) ব্যবহার করতেন। ফলে আমি ক্ষমা ও উত্তম রিযিক প্রাপ্ত হতাম।
[রেফারেন্সঃ আয়েশা (রাঃ) সম্পর্কে ১৫০টি শিক্ষনীয় ঘটনা, পৃষ্ঠা নং- ৩০-৩১]
উপসংহারঃ
আয়েশার (রাঃ) দাম্পত্য জীবন সংক্রান্ত দীর্ঘ ছয় পর্বের সিরিজটি এখানেই শেষ করছি। এই টপিক সংক্রান্ত বহু হাদিস কালেক্ট করে বিভিন্ন টাইটেল দিয়ে আপনাদের সামনে পেশ করেছি। এই হাদিসগুলি যে কেউ পড়লেই বুঝতে পারবে যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং হযরত আয়েশা (রাঃ) এর দাম্পত্য জীবন কতই না মধুর ও সুন্দর ছিল ☺️। আর যারা শুধুমাত্র হযরত আয়েশার বিবাহের বয়স কে কেন্দ্র করে প্রপাগাণ্ডা ছড়াই তাদেরকে আয়েশার (রাঃ) দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে এই সিরিজটিতে উল্লেখিত হাদীসগুলি পেশ করুন, যদি তারা আসলেই সৎ হয় অবশ্যই তারা সেটা গ্রহণ করবে, আর এত প্রমাণ পেশ করার পরেও যদি তাদের বুঝে না আসে তাহলে জেগে ঘুমানো ব্যক্তি কে আপনি কিভাবে জানাবেন??
আসলে যে আয়েশা (রাঃ) রাসূল (সাঃ) কে বিবাহ করেছেন এবং যে আয়েশা এই বিবাহ কে নিয়ে গর্ব করতেন এবং এই বিবাহকে সুন্দর ও সুখময় করে গড়ে তুলেছিলেন, যিনি সুখে দুঃখে সবসময় রাসূল (সাঃ)-এর পাশে থাকতেন, যিনি রাসূল (সাঃ) এর ধর্ম ও আদর্শকে নিজে গ্রহণ করেছিলেন এবং রাসূল (সাঃ) এর দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর দীর্ঘ ৫০বছর ধরে তাঁর স্বামীর রেখে যাওয়া আদর্শকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন, তাঁর কোনো আপত্তি নেই যত আপত্তি আজকে অতিরিক্ত স্মার্ট সাজা কিছু মূর্খ বাটপারদের।আশ্চর্য!!
লিখেছেন-- collected from ইসুলামের ইতিহাস ও সীরাত ©Md Sahil Khan
কোন মন্তব্য নেই: