আল কুরআনের সঙ্কলন ও সংরক্ষণের ইতিহাস
ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো আল কুরআনের সঙ্কলন ও সংরক্ষণের ইতিহাস। আমাদের অনেকেরই এ বিষয় অজ্ঞতা রয়েছে। ফলে অনেক সময়ে পাশ্চাত্যবাদী মিডিয়ার প্রচারণায় এ নিয়ে বিভ্রান্তি পর্যন্ত সৃষ্টি হয়।
আল কুরআনকে আল্লাহ তা'আলা ৭টি আরবি হারফ (বহুবচনে আহরুফ) বা উপভাষায় (Dialects) এ নাজিল করেছেন। এগুলো ছিলো রাসুল(ﷺ) এর সময়কালের ৭টি প্রসিদ্ধ আরব গোত্রের উপভাষা। প্রথম প্রথম কুরআন নাজিল শুরু হয়েছিলো কুরাঈশী উপভাষায়। রাসুল(ﷺ) তাঁর উম্মাহর সহজ করার জন্য এবং ইসলাম প্রচারের সুবিধার্থে আল্লাহ তা'আলার নিকট আরো উপভাষায় কুরআন নাজিলের অনুরোধ করলে আল্লাহ তা'আলা সর্বমোট ৭টি আরবি উপভাষায় কুরআন নাজিল করেন। এ প্রসঙ্গে বিশুদ্ধ বিবরণ রয়েছে। এই ৭টি উপভাষায় ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ছিলো এমনকি ভিন্ন ভিন্ন বাক্যও ছিলো। সে সময়ের প্রাচীন আরবি ভাষায় যবর, যের, পেশ ছিলো না, বিভিন্ন হরফের মধ্যে নুকতাও ছিলো না। লিখিত কুরআনকে বিভিন্নভাবে পড়বার জন্য বিভিন্ন রকম পঠন পদ্ধতি ছিলো। এগুলোকে বলা হয় কিরাত। একেককটি উপভাষার কুরআন অনেক রকম কিরাতে পড়া যেতো। এই সকল হারফ (উপভাষা) এবং কিরাত (পঠন পদ্ধতি) সাহাবীদের মাঝে প্রচলিত ছিলো।
রাসুল(ﷺ) এর ওফাতের পরে আবু বকর(রা.) সমগ্র কুরআন একটি মুসহাফে [অর্থাৎ একই মলাটের মধ্যে সম্পূর্ণ কিতাব আকারে] সংকলনের ব্যবস্থা করেন। আস্তে আস্তে ইসলামী খিলাফাহ তৎকালীন পরিচিত পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকটা অংশে ছড়িয়ে যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায় কুরআনের বিভিন্ন উপভাষা ও বিভিন্ন কিরাতে পঠন হচ্ছে। সকল উপভাষা ও কিরাতের ব্যাপারে সকলের সম্যক ধারণা ছিলো না। ফলে উসমান(রা.) এর সময়ে দেখা গেলো একে অন্যের সম্পূর্ণ সঠিক তিলাওয়াতকেও ভুল বলে সাব্যস্ত করতে শুরু করলো। অনারবরা তো বটেই - এমনকি আরবিভাষীদের মধ্যেও এ ব্যাপারে বিভ্রান্তি দেখা গেলো। কারণ সবাই তো সব আরবি উপভাষা জানতো না। আবার অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কুরআন লিপিবদ্ধ করছিলো। লিখবার সময়ে কুরআনে কিছু জায়গায় ভুল হচ্ছিলো, কেউ কেউ ব্যাখ্যা হিসাবে additional notes লিখছিলো সেগুলোও মূল কুরআনের সাথে মিশ্রিত হবার আশঙ্কা দেখা দিলো। এহেন পরিস্থিতিতে উসমান(রা.) মদীনার সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। সকলে ইজমায় উপনিত হলেনঃ
১। কুরআনের ব্যাপারে আলেম সাহাবীদের দ্বারা আবু বকর(রা.) এর সময়ে সংকলিত মুসহাফের সাহায্যে কুরআনের কিছু Authorized মুসহাফ তৈরি করা হবে।
২। এই মুসহাফগুলোকে ইসলামী সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা হবে। সাহাবীদের সম্মিলিতভাবে প্রস্তুতকৃত সেই মুসহাফ থেকে কপি করে সকলে নির্ভুল মুসহাফ তৈরি করবে।
৩। শুধুমাত্র কুরাঈশী হারফের (উপভাষা) কুরআনকে সংরক্ষণ করা হবে। উম্মতের সহজসাধ্যের জন্য ইসলামের প্রাচীন যুগে বিভিন্ন উপভাষার জরুরত ছিলো। কিন্তু ইসলাম তৎকালীন পরিচিত পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক অংশে ছড়িয়ে যাওয়ায় মুসলিমদের মধ্যে বিশেষত অনারব মুসলিমদের মধ্যে বিভিন্ন হারফ থেকে ঝগড়া সৃষ্টির সম্ভাবনা ছিলো। কেউ হয়তো এক হারফ পাঠ করে অন্য হারফকে ভুল সাব্যস্ত করতে পারতো। তাছাড়া ৭টি হারফে পাঠ করা কোনো Obligation ছিলো না, বরং সহজ করার জন্য একটা Option ছিলো মাত্র। সহজ করা যেহেতু শরিয়তের মাকসাদ ছিলো, এই উসুলের ভিত্তিতেই সাহাবীগণ একটি হারফে কুরআন সংরক্ষোণ করবার সিদ্ধান্ত নিলেন।
৪। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কুরআনের যেসব মুসহাফ তৈরি করা হয়েছিলো এর সবগুলোকে আলেম সাহাবীদের দ্বারা যাচাই করা অসম্ভব ছিলো। কাজেই এর কোনোটির মধ্যে কোন জায়গায় ভুল ছিলো তা সূক্ষ্মভাবে যাচাই কোনোক্রমেই সম্ভব ছিলো না। এসব মুসহাফে সামান্যতম ভুলও যদি রয়ে যায়, তবে তা পরবর্তীকালের জন্য ভয়াবহ সমস্যা তৈরি করবে। কাজেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি কুরআনের সকল মুসহাফ পুড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত হলো। তবে পোড়াবার পূর্বে মুসহাফগুলোর পৃষ্ঠাগুলো ধুয়ে নেয়া হয়েছিলো।
কুরআন সংরক্ষণের গৃহিত এই ব্যবস্থা সকল সাহাবীর ঐক্যমতের ভিত্তিতে ছিলো। তবে মদীনা থেকে দূরে অবস্থানরত কোনো কোনো সাহাবী যেমন আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) এই ব্যবস্থার সকল দিক সম্পর্কে অবহিত না থাকায় নেক নিয়তেই প্রথম প্রথম এর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সকল দিক অবহিত হয়ে তাঁরাও এ ব্যাপারে একমত হয়ে যান বলে বিবরণ রয়েছে। অর্থাৎ কুরআন সংকলনের এই ব্যাবস্থা সকল সাহাবীর ইজমার উপরে প্রতিষ্ঠিত ছিলো।
এভাবে আল কুরআনের কুরাঈশী হারফকে সাহাবীগণ ইজমায় উপনিত হয়ে সংকলন করেন। সাহাবীরা ব্যাপক যাচাই করে নির্ভুল অনেকগুলো কপি তৈরি করেন। সেই কপিগুলো মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। সেই কপিগুলো দিয়ে ইসলামী খিলাফাহর বিভিন্ন প্রদেশে কুরআনের অজস্র কপি তৈরি করা হয়। আমরা আজকে যে কুরআন পড়ি তা সেই উসমানী মুসহাফের কপিগুলোরই উত্তরাধিকার। এই মুসহাফ আবু বকর(রা.) এর আমলে সংকলিত মুসহাফের কুরাঈশী হারফ থেকে হুবহু সংকলিত এবং এটাই হুবহু সেই কুরআন যা রাসুল(ﷺ) উম্মাহর জন্য রেখে গিয়েছিলেন। এই কুরাঈশী হারফের কুরআনকে বিভিন্ন পঠন পদ্ধতি বা কিরাতে পড়া যায়। যেমনঃ হাফস, ওয়ারশ, ক্বালুন ইত্যাদি। এই পঠন পদ্ধতিগুলো সাহাবীদের আমল থেকেই প্রচলিত ছিলো। এখনও আছে। বিশ্বের বেশিরভাগ জায়গাতে হাফস কিরাতটিই পড়া হয়। তবে অন্য কিরাতগুলোও স্বল্প আকারে প্রচলিত আছে।
কুরআন সংকলনের ইতিহাস এবং এর বিভিন্ন আহরুফ (উপভাষা) এর ব্যাপারে বিশাল আলোচনা অতি সংক্ষেপে উপস্থাপনের চেষ্টা করলাম। আশা করি বিষয়টি সকলের বুঝে এসেছে।
কখনো কখনো পাশ্চাত্যবাদী মিডিয়াগুলো দেখানোর চেষাট করে বর্তমান সময়ের থেকে নাকি ভিন্ন ধরনের প্রাচীন কুরআনের Manuscript বা পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়! তাদের এসব প্রচারণায় বিভ্রান্ত বা বিচলিত হবার কিছু নেই। বর্তমান সময়ের কুরআন থেকে ভিন্ন Textযুক্ত প্রাচীন কুরআনের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার হবার পেছনে যে কারণ থাকতে পারেঃ
১। হয়তো সেটি কুরাঈশী উপভাষা থেকে ভিন্ন কোনো উপভাষার প্রাচীন কুরআন
২। অথবা সেটি হয়তো প্রাচীনকালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে লিপিবদ্ধ করা কোনো মুসহাফ যাতে লিপিকার কিছু জায়গায় ভুল করেছেন
কাজেই এই সকল পাণ্ডুলিপি মোটেও কুরআনের সংরক্ষিত থাকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না। কুরআনের বিভিন্ন উপভাষার কথা সহীহ সনদেই বর্ণিত আছে, আমাদের প্রাচীন উলামারা বারংবার এগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন এবং সেই একই উলামারাই কুরআন অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত থাকবার কথা উল্লেখ করেছেন। সমস্যা হলো বর্তমান যুগে মুসলিম উম্মাহর সিংহভাগ লোকই কুরআন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানচর্চা করে না। ফলে তারা কুরআন সংকলনের ইতিহাস এবং এর বিভিন্ন উপভাষার ব্যাপারে অজ্ঞ। তারা যখন বিভিন্ন মিডিয়া থেকে ভিন্ন Wording এর কুরআন Manuscript এর কথা শোনে তখন বেশ ঘাবড়ে যায়। মূলত এখানে ঘাবড়াবার কিছুই নেই। অনেক সময়ে তারা অতি কৌশলে প্রথম দিকে উসমানী মুসহাফের ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) এর আপত্তি সংক্রান্ত বিবরণগুলো উল্লেখ করে বোঝাতে চায় সাহাবীদের মধ্যে বুঝি কুরআন সংকলন নিয়ে ব্যাপক মতবিরোধ (!) ছিলো। আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা.) স্বয়ং যে পরবর্তীকালে উসমানী মুসহাফের ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছিলেন ঐ বিবরণগুলোকে ইসলামবিরোধীরা বেমালুম চেপে যায়।
কোন মন্তব্য নেই: