একজন শাসক। একজন যােদ্ধা। একজন সেনাপতি। জীবনে তিনি ৫৪টি জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন কিন্তু কখনােই পরাজিত হননি। তাঁর পতাকা কখনাে ভূলুণ্ঠিত হয়নি। জয়-পরাজয়ের পরিসংখ্যানে তিনি ইতিহাসের অনেক বিখ্যাত সেনাপতির চেয়ে এগিয়ে থাকবেন। যুদ্ধের ময়দানে তিনি সাথে রাখতেন নিজ হাতে লেখা কুরআনুল কারিম। যখনই সময় পেতেন কুরআনুল কারিম তেলাওয়াত করতেন। তাঁর ভয়ে ইউরােপ ছিল তটস্থ। তাঁর মৃত্যুতে তারা ফিরে পেয়েছিল স্বস্তি। তাঁর মৃত্যুও হয়েছিল জিহাদের ময়দানে। তিনি মুহাম্মদ ইবনু আবদিল্লাহ ইবনু আবি আমের। ইতিহাস তাঁকে চেনে হাজিব আল মানসুর নামে। হাজিব আল মানসুরের জন্ম দক্ষিণ আন্দালুসের জাজিরাতুল খাদরায়। সময়টা ছিল ৩২৬ হিজরি। খ্রিষ্টীয় হিসেবে ৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ। এই গ্রামটি ছিল কুরতুবার কাছেই।এই গ্রামের পথ ধরেই মুসলমানরা প্রবেশ করেছিলেন আন্দালুসে। এই পথ অতিক্রম করেছিলেন তারিক বিন যিয়াদ, মুসা বিন নুসাইর ও আবদুর রহমান আদ-দাখিলের মতাে বরেণ্য সেনানায়করা। এখানেই বেড়ে ওঠেন হাজিব আল মানসুর। তিনি ঘােড়া দাপিয়েছেন উত্তরে বিস্কে উপসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত। তাঁর বাহিনী অতিক্রম করেছিল এমনসব এলাকা, তাঁর আগে কোনাে সেনাপতি বা শাসক যে পর্যন্ত যেতে পারেনি। তিনি কখনাে জয় করেছিলেন সাখরা অঞ্চল, আবার কখনাে ছুটে গিয়েছেন সেন্ট ইয়াকুব নগরীতে। কখনাে তাঁর বাহিনী ঝড়ের গতিতে আছড়ে পড়েছে সান স্টিফেন দুর্গে। তিনি অতিক্রম করেছিলেন পার্বত্য এলাকা, তাঁর সামনে বাধা হতে পারেনি দুর্গম বন্ধুর পথ। প্রতিটি অভিযান থেকে ফিরে তিনি পরনের পােষাক ঝেরে ধুলােবালি সংগ্রহ করতেন। তারপর তা একটি বােতলে জমা করে রাখতেন। তিনি অসিয়ত করে গিয়েছিলেন, তাঁর কাফনের সাথে যেন এই ধুলােবালিও দিয়ে দেয়া হয়। মূলত তিনি একটি হাদিসে বর্ণিত সুসংবাদের প্রতি লক্ষ রেখেই এমনটা করেছিলেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর পথের ধুলাে ও জাহান্নামের আগুন একত্রিত হবে না। ৩৭১ হিজরিতে তিনি হাজিব আল মানসুর উপাধি ধারণ করেন। একবার তিনি সংবাদ পান নাফার রাষ্ট্রে তিনজন মুসলিম নারীকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। দ্রুত তিনি বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করে ফেলেন। এই বাহিনী উপস্থিত হয় নাফার রাষ্ট্রের সীমান্তে। নাফার সম্রাট আতংকিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কেন এসেছেন।তাকে বলা হয়, আপনার রাজ্যের একটি গির্জায় তিনজন মুসলিম নারীকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। নাফার সম্রাট জানান, এই বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এবং দ্রুতই তিনি এর সমাধান করবেন। সম্রাট নিজের উদ্যোগে সেই তিন মুসলিম নারীকে মুক্ত করেন। এর সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের সবাইকে শাস্তি দেন।এমনকি হাজিব আল মানসুরকে সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি গির্জাটিও ভেঙে ফেলেন। একরাতে হাজিব আল মানসুরের এক কর্মচারী তাঁকে বললেন, আমাদের মনিবের চেহারার ক্লান্তি বলে দিচ্ছে তাঁর এখন ঘুম দরকার। নিদ্রাহীনতা তাঁকে অসুস্থ করে দেবে। জবাবে হাজিব আল মানসুর বললেন, যখন প্রজারা ঘুমায় তখন শাসনকর্তা ঘুমাতে পারে না। যদি আমার ঘুম দীর্ঘ হয় তাহলে এই রাজ্যের সমৃদ্ধিও ঘুমিয়ে যাবে। হাজিব আল মানসুর ইন্তেকাল করেন ৩৯৪ হিজরিতে। তাঁর কবর ফলকে কেউ একজন লিখে দিলেন, তাঁর কৃতকর্মই তােমাকে তাঁর সম্পর্কে জানাবে, মনে হবে তুমি নিজ চোখেই তাঁকে দেখছে। তাঁর সময়কালের মতাে সময় হয়তাে আর আসবে না। উপকূলীয় শহর হয়তাে আর কখনাে উত্তপ্ত অগ্নিগর্ভ হবে না। তারপর বহুদিন গত হলাে। আন্দালুস হয়ে পড়লে বিভক্ত। উত্তরে শক্তি সঞ্চয় করলাে খ্রিষ্টানরা। তারা দখল করে নিল একের পর এক রাজ্য। আলফান্সে দখল করে নিল হাজিৰ আল মানসুরের শহর মাদিনাতুস সালেম। আলফান্সের নির্দেশে হাজিব আল মানসুরের কবরের উপর তাবু গাড়া হলাে।সেখানেই রাখা হলাে আলফান্সের শােয়ার খাট। আলফান্সে তার স্ত্রীসহ সেই খাটে বিশ্রাম নিচ্ছিল। হঠাৎ সে বলে উঠলাে, বাহ, আমি মুসলমানদের রাজত্ব দখল করেছি এবং তাদের সম্রাটের কবরের উপর আমার খাট রেখেছি। উপস্থিত একজন বলে উঠলাে, যদি এই কবরে শুয়ে থাকা ব্যক্তি জীবিত থাকতেন তাহলে আপনি আজ এখানে থাকা দূরের কথা এই রাজ্যের দিকে চোখ তুলে তাকানাের সাহসও পেতেন না। তিনি আমাদের কাউকেই ছাড়তেন না। এই কথা শুনে আলফান্সো রেগে যায়। তখন তার স্ত্রী তাকে বলে, সে সত্যই বলেছে। তুমি কি নিজেকে তার (হাজিব আল মানসুর) মতাে মনে করাে?
লেখক - ইমরান রাইহান
কোন মন্তব্য নেই: