১৯০৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে অল-ইন্ডিয়া মােহামেডান এডুকেশন্যাল কনফারেন্স'-এর ২০তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি নওয়াব সলিমুল্লাহের ভাষন,
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
"আলহামদুলিল্লাহি" রাব্বিল আলামীন, ওয়াস-সালাতু ওয়াসসালামু আলা সাইয়িদিনা মুহাম্মাদিন, ওয়া-আলা আলিহি ওয়া- আসহাবিহি আজমাঈন ওয়াল-আকিদাতু লিল মুওাকিন।"
জনাব,
স্বাগত জানাবার পূর্বে আপনাদের শুভ ভবিষ্যত কামনা করেই এ দোয়াটি পাঠ করলাম। এর উদ্দেশ্য হলাে-স্বজাতির উন্নতির জন্য আমরা যেসব চেষ্টা করে চলেছি, তাতে যেন আল্লাহ পাক ও তাঁর রসুল আমাদের সহায় হন। আমি নিজেকে এজন্য ভাগাযবান মনে করছি যে, আপনাদের ন্যায় ‘অল-ইন্ডিয়া এডুকেশনাল কনফারেন্স'-এর সম্মানিত ও উজ্জ্বল ধ্যান- ধারণাসম্পন্ন সদস্য, পর্যবেক্ষক ও কর্মকর্তাদের স্বাগত জানাবার গুরুদায়িত্ব অভ্যর্থনা কমিটি আমার উপর অর্পণ করেছেন। আপনারা কষ্ট স্বীকার পূর্বক সুদূর পথ সফর করে ঢাকায় পদার্পণ করেছেন; জাতীয় সহানুভূতি আপনাদের শুভাগমন আমাদেরকে উচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছে। পূর্ববাংলার মুসলমানদের তরফ থেকে এজন্য আপনাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা আমার পবিত্র দায়িত্ব। আমার বক্তব্য পেশ করার পূর্বেই মুর্শিদাবাদের মহামান্য নওয়াব বাহাদুর জি সি এস আই-এর মর্মান্তিক মৃত্যু সম্পর্কে আপনাদের অবহিত করা আমি জরুরী বলে মনে করি। তার মৃত্যুতে আমাদের জাতি শাহী খান্দানের একজন খ্যাতিমান সদস্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তার পুত্র অনারেল ওয়াসিফ কদর ইউসুফ মিজার উপর আমাদের এ ভরসা রয়েছে যে, তার পিতার মৃত্যুতে আমাদের জাতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূর্ণ থাকবে না; মরছে নওয়াবের বংশধরগণের সম্মান ও খ্যাতি ভবিষ্যতেও এখনকার মত অটুট ও উজ্জল। বিগত অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে কোন সময় আমরা তথা ঢাকার অধিবাসীরা স্বপ্নেও এটা ভাবতে পারিনি যে, আমাদের জাতির খ্যাতনামা শিক্ষিত ও সুধীবর্গের এত বড় একটি দল আমাদের অবস্থা দেখার জন্য ঢাকায় পদার্পণ করবেন। এটা আমাদের সৌভাগ্য। আপনাদেরকে এখানে পেয়ে আজ আমরা আনন্দিত। ঢাকা শহর ভারতের সুদূর পূর্ব দিগনতে অবস্থিত, দিল্লীর বাদশাগণ এ শহরকে তাদের রাজধানী করেছিলেন। অর্ধশতাব্দী পূর্বে এ শহরটি তার সকল অতীত গৌরব হারিয়ে ফেলে। সেই অতীত গৌরব ফিরে পাওয়া বা ভারতের অন্যতম বড় ও বিখ্যাত শহররূপে পুনরায় পরিগণিত হওয়ার কোন আশাও এর ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা অতীব মহান; তাঁর রহমত সার্বজনীন; তার কাছে বাদশা ফকীর সবাই সমান; যাকে চান, তাকে বাড়ান, যাকে চান, তাকে খর্ব করেন; আলা দানের পর রাতের অন্ধকার বিছিয়ে দেন; রাতের আঁধারের পর আবার দিনের ঔজ্জ্বল্য সৃষ্টি করেন। ঢাকা শহরের উত্থান- পতনের ইতিহাস এই মর্মকথারই প্রতিধবনি করে। আমি আপনাদের এ মর্মে নিশ্চিত ধারণা দিতে চাই যে, গত দু'বছরের স্বল্প পরিসরে ঢাকা শহর অপ্রত্যাশিতভাবে অতি দ্রুত গতিতে ও বিস্ময়করভাবে অধঃপতনের গহর থেকে উন্নতির শিখরে আরােহণ করেছে।
জনাব, গত বছরের স্বল্প পরিসর সময়ে ঢাকা ও পূর্ব বাংলার ইতিবৃত্তে আশাপ্রদ অনেক বিপ্লব সাধিত হয়েছে। আমরা আশা করি, অদর ভবিষ্যতে এর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে। ঢাকার শাসন ক্ষমতা ও গৌরব অবলুপ্ত হওয়ার পর থেকেই মান-সম্মাল, জ্ঞান-গরিমা ও অর্থ-সামর্থের দিক থেকে এখানকার মুসলমান নাগরিকদের অবস্থা অবনতির অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে শুরু করে। আমি মনে করি, মুসলমানদের জন্য এটা খুবই আনন্দের বিষয় যে, সেই সর্বশক্তিমান যুগস্রষ্টা আমাদের মেহেরবান গভর্ণমেন্টকে তার দরিদ্র প্রজাকুল, বিশেষত এই প্রাকৃতিক প্রদেশের মুসলিম নাগরিকদের শােচনীয় অবস্থা হৃদয়ঙ্গম করার তাওফিক দিয়েছেন এবং এর প্রতিকারে তাকে প্রবুদ্ধ করেছেন। আমি একান্তভাবে কামনা করছি, বিশ্বপালক যেন তার রহমতের দ্বার সব সময় আমাদের জন্য উন্নুক্ত রাখেন। আমরা সেই শিক্ষিত ও সুধী মুসলমান ভাইদের, বিশেষত আলীগড় মহোদয়গণের ঋণ কিভাবে শোধ করতে পারবাে না, যারা পূর্ব বাঙলার ভাইদের পশ্চাৎপদতা ও লােচনীয় অবস্থা লক্ষ্য করে তাদের সাহায্যার্থে এবং সুপরামর্শ দিয়ে উপকার সাধনের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ কষ্ট স্বীকার করে সুদূর জলপথ ও হলপথ অতিক্রম করে নিজ ব্যয়ে ঢাকায় পদার্পণ করেছেন। আপনাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। এর সাথে সাথে যদি এ নতুন প্রদেশের প্রকৃত উপকারক ও এ প্রদেশের স্রষ্টা তথা বড়লাট কার্জন এবং পূর্ব বাংলার প্রথম লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার ব্যামফিন্ড ফুলারের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা না হয়, তবে তা হবে কৃতঘ্নতার শামিল। যে ফলপ্রসু নীতির উপর ভিত্তি করে আমাদের মহীয়াল ও দূরদর্শী শাসনকর্তাগণ নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করেছেন, সে সম্পর্কে বেশি কিছু বলতে চাই না। কারণ, বিষয়টি আমার বর্তমান আলােচনার গল্ডি বহির্ভূত। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় বাপারে কিছু আলােচনা করার জায়গাও এটা নয়।
জনাব, আমাকে এতটুকু আরজ করার অনুমতি দেবেন যে, আমরা-তথা পূর্ব বাঙলার অধিবাসীরা অত্যন্ত আনন্দ সহকারে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আপনারা এমন এক উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে সমবেত হয়েছেন, এ প্রদেশবাসীর যা একান্ত প্রয়ােজন রয়েছে। আমি এ মহৎ ও ভাবগম্ভীর সভায় সংকোচ নিয়ে এটা স্বীকার করছি যে, আমাদের শিক্ষার অবস্থা খুবই শােচনীয়। কলকাতায় ৩ জন অশিক্ষিতের অনুপাতে ১ জন শিক্ষিত, অথচ ঢাকায় ৮ জন অশিক্ষিতের অনুপাতে মাত্র ১ জন শিক্ষিত লােক রয়েছে। গােটা বঙ্গে ১২ জন অশিক্ষিতের অনুপাতে ১ জন শিক্ষিত এবং দু-এক জায়গায় ১৬ জন অশিক্ষিতের অনুপাতে মাত্র ১ জন শিক্ষিত লােক রয়েছে। মুসলমান শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের অনুপাত হলাে ১৪১৫। অন্য কথায়, সমগ্র বঙ্গ প্রতি ১৬ জন মুসলমানের মধ্যে ১৫ জনই অশিক্ষিত। এতে আপনারা অনুধাবন করতে পারবেন যে, আমরা তথা মুসলমানরা শিক্ষায় কত পশ্চাৎপদ। দেশের যেসব অঞ্চলে যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল ছিল, সেখানে তাহযীব-তমন প্রসার লাভ করেছে, কিন্তু পূর্ববাংলা শাসনকর্তৃপক্ষের দৃষ্টি থেকে দূরে থাকায় তা দিন দিন লয়প্রাপ্ত হতে থাকে। লর্ড কার্জন ও স্যার ব্যামফিল্ড ফুলারের প্রজ্ঞাই আমাদেরকে ধবংসের হাত থেকে মুক্তির পথে টেনে এনেছে এবং আমাদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চর করেছে। এ পথ ধরেই আপনাদের মনে আমাদের প্রয়োজন ও সাহায্যের কথা উদিত হয়েছে। আমি এটা স্বীকার না করে পারছি না যে, ওয়ারেন হেস্টিংসকে ১ম গভর্নর জেনারেল নিয়ােগের সময় তথা বর্তমান ইংরেজ শাসনের সূচনালগ্ন থেকে আমাদের জাতির অনেক নেতাই এই প্রান্তিক প্রদেশের শােচনীয় অবস্থার প্রতি শাসনকর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমি আল্লাহর শুকর এজন্য আদায় করছি যে, স্ব জাতির উন্নতির উষাপর্ব দেখা আমার ভাগ্যেই নিহিত ছিল। আমি আল্লাহর কাছে মুনাজাত করছি- আমাদের শাসকদের কৃপাদৃষ্টি এ প্রদেশের প্রতি চির অটুট থাকুক, তাহলে যেন আমি আবার নৈরাশ্যের সেই গহুরে না পড়ি যেখানে বিগত এক শতাব্দীকাল ব্যাপী আমরা.................।
জনাব,
এতক্ষণ আমি আপনাদের সামনে দেশের কোন শুভ দিক তুলে ধরিনি। এখন এমন দু'একটি ঘটনার অবতারণা করার প্রয়ােজন মনে করি, যা বিগত ১২ মাসে আমাদের জাতি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে। এই ব্যাপারে এগুলাে হলাে এমন কতক আসন্ন ঘটনার ইঙ্গিত বাহক, যার লক্ষণ ইতিমধ্যেই প্রতিভাত হয়েছে। এসবের মধ্যে একটি ছিল প্রতিশ্রুত ভাবী মহামান্য সম্রাট ও তার বেগম সাহেবার ভারত আগমন এবং আমাদের শিক্ষার প্রতি তাদের বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ। আলীগড় কলেজ পরিদর্শন ছিল তাদের এ আগ্রহের পরিচায়ক। আমাদের সম্মান বৃদ্ধির জন্য আমরা তাদের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। আমি যতটুকু জানি, তারা আর কোন জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এতটুকু সম্মান দেননি, যা আলীগড় কলেজকে দিয়েছেন। আমাদের জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের এই আগমন খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। আমাদের ভারতীয় মুসলমানদের বর্তমান ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল বড় লাটের সাথে নিখিল ভারত মুসলমান প্রতিনিধি দলের সাক্ষাঙ্কার এবং তাদের প্রতি সহানুভুতিমূলক ও আশাপ্রদ উত্তরদান। এটাও আমাদের জন্য একটি সুখকর বিষয়। তৃতীয়তঃ সবচাইতে ফলদায়ক ব্যাপার হলাে, ভারতের প্রায় সকল অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে অনুভূতি ও জাগরণ সৃষ্টি। তারা এখন নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয়েছে। আমার বিশ্বাস, এই উক্তিতে আমি সকল মুসলমানের অডিমতেরই প্রতিধবনি করছি। আমাদের মধ্যে যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে, তোমাদের ভবিষ্যত কল্যাণ ও সুখময় জীবন লাভের সবচাইতে বড় ও নিশ্চিত লক্ষণ। আমি যদিও আরো একটি কথা সর্বশেষে বলছি, কিন্তু তা হলাে খুবই আনন্দের বিষয়। সে কথাটি হলাে- ১৯০৬ সালের ক্রান্তিলগ্ন আমরা স্বজাতির দুজন সম্মানিত লােককে হাইকোর্টের বিচারপতিপদে পেতে যাচ্ছি। সবচাইতে আনন্দের বিষয় হলো-ধ্যে একজন এখানে উপস্থিত হয়ে আমাদের শির উচ্চ করেছেন এবং এ সম্মিলনে সভাপতিত্ব করার। অনুমতি প্রদান করেছেন-'কনফারেন্স'-এর বিশ বছরের জীবনে কি কি সুফল ফলেছে তা এই নিয়ােগেই প্রতিপন্ন হয়। অল-ইন্ডিয়া এডুকেশন্যাল কনফারেন্স-এর চেষ্টায় আমাদের মধ্যে অত্যন্ত উপযুক্ত, প্রজ্ঞাবান ও শিক্ষিত মুসলমান সৃষ্টি হয়েছে। এরা খুবই যােগ্যতা সহকারে সে সব বড় বড় পদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন, যেগুলোকে বর্তমানে সরকারী চাকুরিতে ভরতের সর্বোচ্চ পদ বলে মনে করা হয়। এসব লক্ষণ স্বজাতির উন্নতি অব্যাহত রাখার পথে আমাদের জন্য খুবই সাহসপ্রদ ও উৎসাহব্যঞ্জক। জনাব, আমি আশা করি, অভিবাদন পত্র পাঠ শেষ করার পরেই আপনারা আমাকে ব্যক্তিগত একটি বিষয়ে কিছু বলার অনুমতি দেবেন। আমি আপনাদের কাছে এই আবেদন করেছিলাম যে, ঢাকায় অবস্থানকালে আপনারা আমার অতিথি হবেন। আপনারা আমার অনুরােধ রক্ষা করেছেন। আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য আপনাদের নিকট আমি কৃতজ্ঞ ন্তুি এর সঙ্গে আমি এই নিবেদনও করবে যে, আপনাদের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থাপনায় যদি কোন ক্রুটি হয়ে থাকে এবং তার ফলে আপনারা কষ্ট অনুভব করে থাকেন, তবে আশা করি, আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনাদেরকে আমি এ মর্মে বিশ্বাস করাতে চাই যে, কোন ক্রুটি হয়ে থাকলে তা আমাদের উদাসীনতায় ও অজ্ঞাতসারে হয়নি। আপনার বিশ্বাস করুন, আপনাদের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থাপনায় এবং আপনাদের অবস্থানাগারে সুখ-শান্তি বজায় রাখতে অত্যর্থনা কমিটির সদস্যগণ কোন প্রকার ত্রুটি করেননি।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
কোন মন্তব্য নেই: