★★আয়ারল্যান্ডবাসীর কাছে অমর সুলতান আব্দুল মজিদ★★
১৮৪৫ সাল। এক মহাদুর্ভিক্ষের কবলে আয়ারল্যান্ড। এর আগে কয়েক বছর ধরে আয়ারল্যান্ড দ্বীপের কোথাও আলুর ভালো ফলন হয়নি। খেতে-খামারে অজানা রোগ ছড়িয়ে পড়ায় অধিকাংশ আলু নষ্ট হয়ে যায়। অথচ সেখানকার গরিব মানুষের প্রধান খাদ্য এই আলু।
দুর্ভিক্ষের শিকার ২০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষুধার তাড়নায় দেশ ছেড়ে চলে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশে। খাদ্যাভাবে ক্ষুধার কষ্টে মারা গেছে আরও প্রায় ১০ লাখ মানুষ। জনসংখ্যা থেকে খালি হয়ে যাচ্ছে আয়ারল্যান্ড। উত্তর আয়ারল্যান্ডে উর্বর ভূমিতে যেসব খাবার চাষ হচ্ছিল, সেসব ভোগ করছে ব্রিটিশ ইংরেজরা। আয়ারল্যান্ড তখন ব্রিটেনের উপনিবেশ। ব্রিটেনের রানি ভিক্টেরিয়ার শাসনে আয়ারল্যান্ডসহ অন্যান্য অঞ্চল। আয়ারল্যান্ডের সাহায্যার্থে রানি ভিক্টোরিয়া পাঠিয়েছেন এক হাজার পাউন্ড।
উসমানি সাম্রাজ্যের তৎকালীন তরুণ সুলতান প্রথম আব্দুল মজিদ জানতে পারেন এই দুর্ভিক্ষের সংবাদ। অভাবে মারা যাচ্ছে মানুষ, এ খবরে কেঁদে ওঠে তাঁর মমতাময় হৃদয়। ধর্ম ও জাতীয়তার সব বিভেদ ভুলে চার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত আয়ারল্যান্ডের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন তিনি।
সুলতান প্রথম আব্দুল মজিদ ঘোষণা করলেন, আয়ারল্যান্ডের অভাবী কৃষকদের জন্য তিনি ১০ হাজার ইস্টারলিং (রুপার পাউন্ড) দান করবেন, বর্তমান সময়ে যা আট লাখ পাউন্ডের সমান। সুলতানের ঘোষণায় হইচই পড়ে যায় ব্রিটিশ রাজপরিবারে। আয়ারল্যান্ডের জন্য রানি দিয়েছেন দুই হাজার পাউন্ড, কিন্তু দূরের একজন মুসলিম সুলতান দেবেন ১০ হাজার পাউন্ড। এটা রানির জন্য অপমানজনক ব্যাপার।
পআয়ারল্যান্ডের অধিবাসীরা ছিল ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। আর ব্রিটিশরা ছিল প্রটেস্ট্যান্ট। ফলে খ্রিষ্টান ধর্মের এ দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে সদ্ভাবের অভাব ছিল। ব্রিটিশ শাসকেরা নানাভাবে আয়ারল্যান্ডের অধিবাসীদের দমিয়ে রাখত।
ইস্তাম্বুলে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত হেনরি ছুটে এলেন সুলতানের কাছে। তিনি তাঁকে বোঝান, মহারানি যে পরিমাণ অর্থ দিয়েছেন, এর চেয়ে বেশি দেওয়া মানে তাঁকে ছোট করা। কাজেই আপনি মহারানির দানের অর্ধেক দান করুন। সুলতান প্রথম আব্দুল মজিদ তাঁর অনুরোধে সম্মত হলেন। তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নগদ এক হাজার পাউন্ড অর্থ সহায়তা পাঠাতে আদেশ দিলেন।
সুলতান সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁর প্রতিশ্রুত ১০ হাজার পাউন্ডের বাকি অর্থের বিনিময়ে তিনি গম পাঠাবেন আয়ারল্যান্ডের অভাবী কৃষকদের জন্য। সুলতানের ইচ্ছাপূরণে উসমানি সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে খাদ্যপণ্যভর্তি তিনটি জাহাজ গোপনে রওনা হয় আয়ারল্যান্ডের উদ্দেশে।
কিন্তু এ নৌবহরের খবর জেনে যায় ব্রিটিশ নৌবাহিনী। উসমানি সম্রাজ্যের একজন মুসলিম সুলতানের সাহায্য যেন কোনোভাবেই আয়ারল্যান্ডে পৌঁছাতে না পারে, সে জন্য তারা রাজধানী ডাবলিন এবং অন্য আরেকটি শহর বেলফাস্ট বন্দরে পৌঁছার পথে উসমানি ত্রাণবহরকে বাধা দেয়। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর বাধায় ফেরার পথে কৌশলে আয়ারল্যান্ডের আরেকটি শহর ড্রগেডার বন্দরে নোঙর ফেলে উসমানি ত্রাণবাহী জাহাজ। তারপর দ্রুততম সময়ে শহরবাসীর মধ্যে বিতরণ করা হয় সুলতানের পাঠানো ত্রাণসামগ্রী। ড্রগেডা শহরটি রাজধানী ডাবলিন থেকে ৭০ মাইল দূরে অবস্থিত।
আয়ারল্যান্ডের ড্রগেডা শহরের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ একজন মুসলিম সুলতানের এমন মানবিক উদারতায় অভিভূত হয়ে পড়ে। ভিন্ন ধর্মের এবং দূরদেশের একজন হৃদয়বান সুলতান তাদের জন্য অর্থ ও খাদ্য সহায়তা পাঠিয়েছেন, এ নিয়ে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন আলোচনা চলে।
ড্রগেডা শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং বিশিষ্টজনেরা উসমানি সুলতান প্রথম আব্দুল মজিদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে একটি ধন্যবাদপত্র পাঠান। উসমানি আর্কাইভে আজও সেই পত্র সংরক্ষিত রয়েছে। তাতে লেখা আছে,
'We the noblemen, gentlemen and inhabitants of Ireland want to express our thank and gratitude for the Ottoman Sultan's munificent assistance due to the disaster of dearth. It is unavoidable for us to appeal the assistance of other countries in order to be saved from the enduring threat of death and famine. The Ottoman Sultan's munificent response to this aid call displays an example to European States. Numbers were relieved and saved from perishing through this timely act. We express our gratitude on their behalf and hope that the Ottoman Sultan and his dominions will be saved from the afflictions which have befallen us.'
সেদিন ড্রগেডা শহরে অভাবীদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ শেষে উসমানি নাবিক ও ত্রাণকর্মীরা যে রুমে বিশ্রাম নিয়েছিলেন, সেই রুমটি আজও আয়ারল্যান্ডবাসীর কাছে স্মরণীয়। ওয়েস্টকোর্ট হোটেলের পাশে অবস্থিত ওই রুমের ওপর একটি
ফলক রয়েছে। তাতে লেখা আছে,
The Great Irish Famine of 1847IIn remembrance and recognition of the generosity of the People of Turkey towards the People of Ireland.
এই ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে দেড় শ বছরের বেশি সময়। কিন্তু সুদূর ড্রগেডা শহরের ফুটবল দলের DROGHEDA UNITED F.C লোগোতে উসমানি সাম্রাজ্যের প্রতীক চাঁদ-তারা আজ অবধি উসমানি সাম্রাজ্যের হৃদয়বান সুলতান আব্দুল মজিদের প্রতি শহরবাসীর কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হয়ে আছে।
১৯৯৫ সালে ড্রগেডা শহরের মেয়র উসমানি সুলতান আব্দুল একটি স্মৃতিফলক উন্মোচন করেন। এর মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের কাছে এই সুলতানের অমূল্য সহযোগিতার নিদর্শন ধরে রাখতে চান তিনি।
২০১০ সালে তুরস্ক সফরে আয়ারল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ম্যারি ম্যাকলিস। সে সময় তিনি উসমানি সুলতান প্রথম আব্দুল মজিদকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন। তুরস্কের রাষ্ট্রপতিকে তিনি ফেরেশতাতুল্য বলেছিলেন, এই মহান সুলতানকে আমরা ভুলিনি। তাঁর সাহায্য না পেলে আজ আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত থাকতে পারতাম না। আমরা আইরিশরা তাঁর কাছে আসেন
কৃতজ্ঞ। ২০১৫ সালের মে মাসে ড্রগেডা শহরে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে নগর কর্তৃপক্ষ উসমানি সাম্রাজ্য এবং বর্তমান তুরস্কের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। গত দেড় শ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিবছর ওই বন্দরে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যেখানে উসমানি সুলতানের পাঠানো ত্রাণবাহী জাহাজ থেমেছিল।
গ্রন্থ :সুলতান কাহিনি, তামীম রায়হান।
কোন মন্তব্য নেই: